খুলনা | রবিবার | ২৭ জুলাই ২০২৫ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

দু’দেশের সীমান্তবর্তী লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে গোলাগুলি, নিহত বেড়ে ১৬

খবর প্রতিবেদন |
০১:৪২ এ.এম | ২৬ জুলাই ২০২৫


সীমান্তবর্তী বিতর্কিত এলাকায় টানা দ্বিতীয় দিনের মতো গোলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। সর্বশেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত দুদিনের এ সংঘাতে নিহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ জনে, নিহতদের ১৫ জন থাইল্যান্ডের নাগরিক, একজন কম্বোডীয়। ঘর ছেড়েছেন দুদেশের সীমান্তবর্তী ১ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দা। 
যুদ্ধের মাত্রা ও পরিধি যাতে না বাড়ে সে লক্ষ্যে শুক্রবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা।
সিএনএন জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনামলে নির্ধারিত সীমান্তে বেশ কয়েকটি প্রতœতাত্তি¡ক ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে, যা উভয় দেশই নিজেদের দাবি করে।
শুক্রবার ভোররাত সাড়ে ৪টায় কম্বোডিয়ার বাহিনী গুলি ছুড়লে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী পাল্টা কামান ও ভারী অস্ত্রে জবাব দেয় বলে জানিয়েছেন থাই কর্নেল রিচা সুকসুয়ানন। সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু ছিল থাইল্যান্ডের উবন রাচাথানি ও সুরিন প্রদেশের তিনটি পয়েন্ট।
থাই সেনাবাহিনী জানায়, কম্বোডিয়ার দিক থেকে ভারী রকেট হামলার জবাবে তারা বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও মরদেহ উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছে।
সংঘর্ষের ভিডিওতে থাই কামানের বিকট শব্দ ও ধোঁয়া দেখা গেছে। সংঘর্ষের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার কামান ও রকেট উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে। এরপর থাইল্যান্ড তাদের এফ-১৬ জেট পাঠিয়ে কম্বোডিয়ার ভেতরে ‘সেনাঘাঁটিতে’ হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।
কম্বোডিয়া দাবি করেছে, থাই সেনাবাহিনী শুক্রবার সকালে দু’টি স্থানে ক্লাস্টার বোমাও ব্যবহার করেছে। এই অভিযোগে থাই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সিএনএন আরও জানিয়েছে, কম্বোডিয়ার ওদার মিনচেই প্রদেশে অন্তত একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছে। ওই অঞ্চল থেকে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই রাতের আঁধারে গাড়ি বোঝাই করে বাড়ি ছেড়েছে। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে ত্রিপলের নিচে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, নিহতদের সবাই থাইল্যান্ডের নাগরিক, যাদের মধ্যে ১৪ জনই বেসামরিক। দু’দিনের এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত আহত হয়েছেন আরও ৪৬ জন। আহতদের মধ্যেও বেশির ভাগ বেসামরিক নাগরিক। এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী। হতাহত কমাতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর প্রায় দেড় লাখ বাসিন্দাকে নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা নিকটবর্তী ৩০০ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
এদিকে, চলমান সংঘাতে কম্বোডিয়ায় কতজন হতাহত হয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। দেশটির সীমান্তবর্তী ওডার মিনচি প্রদেশের স্থানীয় সরকার জানিয়েছে, ওই অঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ সংঘাতকে গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে বড় সংঘাত বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
থাইল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুধু বৃহস্পতিবার রাতেই ১ লাখের বেশি মানুষকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সুরিন প্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে মেঝেতে বিছানা করে আশ্রয় নিয়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেছেন, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই পরিস্থিতি খুব কষ্টদায়ক। অনেকেই গাড়ি না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতেই পারছে না।’
সংঘর্ষের বিষয়ে থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক থিতিনান বলেছেন, দুইপক্ষই অতীত ইতিহাস নিয়ে ক্ষুব্ধ। থাইদের ধারণা, ফরাসিরা তাদের জমি নিয়ে কম্বোডিয়াকে দিয়েছে। অপর দিকে কম্বোডিয়ানদের বিশ্বাস, এই ভূমি তাদের প্রাচীন সভ্যতার অংশ।
সামরিক শক্তির বিচারে কম্বোডিয়ার চেয়ে থাইল্যান্ড অনেক এগিয়ে। তাদের সক্রিয় সৈন্যসংখ্যা ৩ লাখ ৬১ হাজার, যা কম্বোডিয়ার তুলনায় তিন গুণ বেশি। তা ছাড়া থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সহায়তাও পাচ্ছে।
তবে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ভুগছে থাইল্যান্ড। চলতি মাসেই একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়। ফোনালাপে তিনি নিজ দেশের সেনাবাহিনীর আচরণ নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন।
এই সংঘর্ষ শুধু সীমান্ত নয়, বরং আঞ্চলিক রাজনীতি, ইতিহাস ও শক্তির ভারসাম্যকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ইতিমধ্যেই উভয় পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধের আহŸান জানিয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার বিতর্কিত স্থানীয় সময় সকালে বিতর্কিত তা মোন থম মন্দির ঘিরে সংঘর্ষে জড়ায় উভয় পক্ষ। ওই সংঘর্ষে সকালেই নিহত হয় থাইল্যান্ডের দুই বেসামরিক নাগরিক। এর জেরে কম্বোডিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেয় থাইল্যান্ড। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কম্বোডীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারেরও। হামলার পরপরই থাই কর্তৃপক্ষ জানায়, কম্বোডিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ে’ নামিয়ে আনছে তারা। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কম্বোডিয়াও তাদের সব কূটনীতিককে থাইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে নেয় এবং থাই কূটনীতিকদেরও দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়।