খুলনা | মঙ্গলবার | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৫ ভাদ্র ১৪৩২

রাজধানীতে সেনা মোতায়েন, বেড়েছে কারফিউয়ের আওতা

নেপালে বিক্ষোভে ভয়াবহ সহিংসতায় নিহত ১৯

খবর প্রতিবেদন |
০১:০৫ এ.এম | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫


সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপস ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির প্রতিবাদে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছে হিমালয় কন্যা নামে পরিচিত দেশ নেপালে। বিক্ষোভ দমন করতে রাজধানী কাঠমান্ডুতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে সরকার।
বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে দেশটির তরুণ প্রজন্ম। স¤প্রতি নেপালে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরকারের আদেশে নিষিদ্ধ হওয়ায় বিক্ষোভ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। 
সোমবার সকালে রাজধানী কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর এলাকায় প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে দেশটির পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান নিক্ষেপ করে। নেপালের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী নিহত বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে শুধু কাঠমান্ডুতেই ১৭ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও শত শত বিক্ষোভকারী। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে জলকামান, কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি ব্যবহার করেছে। 
বিক্ষোভে অংশ নেয়া তরুণ এক বিক্ষোভকারী অন্যদের শান্ত থাকার আহŸান জানিয়ে বলেন, ভেতর থেকে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনতার আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আজ (সোমবার) আমরা ইতোমধ্যে জয়ী হয়েছি। 
কারফিউয়ের আওতা বাড়ানো : দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুতে কারফিউয়ের আওতা বাড়ানো হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার নিরাপত্তা বাহিনী ও জেন-জি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার পর সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। 
কারফিউ জারি করেছেন কাঠমান্ডুর প্রধান জেলা কর্মকর্তা (চিফ ডিস্ট্রিক্ট অফিসার) ছবিলাল রিজাল। প্রথমে কাঠমান্ডুর বানেশ্বর এলাকার কিছু অংশে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কারণ, আন্দোলনকারীরা সেখানে সুরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। পরে প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন শীতল নিবাস, মহারাজগঞ্জ, ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবন লায়নচাওর, সিংহ দরবারের চারপাশ, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বলুয়াটার এবং আশপাশ এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়।
কারফিউ চলাকালে উলি­খিত এলাকায় চলাফেরা, সমাবেশ, বিক্ষোভ বা ঘেরাও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সংঘাত এড়াতে নাগরিকদের ঘরে অবস্থান এবং কারফিউ মেনে চলার আহŸান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কারফিউয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
উলে­খ্য, ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নিয়েছিল সরকার পতনের আন্দোলনে। আন্দোলনকারীদের দমাতে ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে সকল যোযোগযোগ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের মতোই স¤প্রতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি নেতৃত্বাধীন সরকার জেন-জি’দের দমাতে ফেসবুক, ইউটিউব এবং এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর প্রতিবাদে রাজধানী কাঠমান্ডুতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন হিমালয়কন্যা খ্যাত দেশটির অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। 
এর আগে, দেশটির সরকারি এক নোটিশে বলা হয়েছিল, ২৮ আগস্ট থেকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে সচল সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ), ইউটিউব, এক্স, রেডিট এবং লিংকডইনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউই আবেদন জমা দেয়নি। গত বছর নেপালের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া এক নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিবন্ধনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয় দেশটির সরকার। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে দেশটিতে নিজেদের অফিস এবং একজন অভিযোগ নিষ্পত্তি ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা নিয়োগ করতে বলা হয়েছিল। বর্তমানে টিকটক, ভাইবার, উইটক, নিম্বাস এবং পোপো লাইভ দেশটিতে নিবন্ধন করেছে। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেপালে সচল রয়েছে।
বাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সচলের দাবি নিয়ে সোমবার সকালে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় সংহিসতায়। আন্দোলনকারীরা এক পর্যায়ে পার্লামেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এতেই অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। 
নেপালের ন্যাশনাল ট্রমা সেন্টারের চিকিৎসক ডাঃ দীপেন্দ্র পাণ্ডে বলেছেন, হাসপাতালটিতে সাতজন বিক্ষোভকারীকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, হাসপাতালে আসা আরও ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের প্রত্যেকের মাথা ও বুকে গুলির আঘাত রয়েছে। সেখানে আরও ২০ জনেরও বেশি চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া বানেশ্বরের এভারেস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অন্তত তিনজন মারা গেছেন বলে সেখানকার কর্মকর্তা অনিল অধিকারী নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে অন্তত ৫০ জন বিক্ষোভকারী আহত অবস্থায় এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর।
কাঠমান্ডুর সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত দুই বিক্ষোভকারী মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির নির্বাহী পরিচালক মোহন চন্দ্র রেগমি। এছাড়া কেএমসি হাসপাতাল এবং ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় টিচিং হাসপাতালে একজন করে বিক্ষোভকারী মারা গেছেন। নিহতদের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জাতীয় ট্রমা সেন্টারে আনা সাতজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতালের ডাঃ দীপেন্দ্র পান্ডে নিশ্চিত করেন। তিনি আরও বলেন, মাথা ও বুকে গুলি লেগেছে, আরও ১০ জনের অবস্থা গুরুতর এবং আরও ২০ জনেরও বেশি চিকিৎসাধীন। 
কাঠমান্ডু এবং অন্যান্য বড় শহর জুড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে, জেনারেল জেড-এর বিক্ষোভকারীরা সোশ্যাল মিডিয়া বিধিনিষেধ এবং সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ করেন। 
এদিকে দুপুর থেকেই কূটনৈতিক পাড়াতে কারফিউ জারি করেছে নেপাল সরকার। তবে টুরিস্ট এলাকা বলে পরিচিত থামেলের হোটলে পাড়াতে সেভাবে আন্দোলনের প্রভাব পরেনি। এখানকার হোটেলগুলোতেই মূল নেপালে আসা টুরিস্টরা অবস্থান করেন।
নেপালের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন শীতল নিবাস, ভাইস প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন, রাজপরিবারের প্রধান প্রাসাদ সিংহ দরবার, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসবভন ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। 
সহিংস বিক্ষোভ শুধু কাঠমান্ডুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নেপালের বুটওয়াল, ভৈরহাওয়া ও ইটাহারিসহ কয়েকটি জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় দামাকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়, আর ইস্ট-ওয়েস্ট হাইওয়ে অবরোধ করে আগুন জ্বালানো হয়।
সূত্র: কাঠমান্ডু পোস্ট, এএফপি।