খুলনা | মঙ্গলবার | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৩১ ভাদ্র ১৪৩২

আগের ট্রাইব্যুনালের প্রহসন প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান : দেশে মব কালচার প্রতিষ্ঠা করে গণজাগরণ মঞ্চ

‘আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আমি বসাইয়া দিমু, সবাই ভাববে আমাদের খাতির নেই’

খবর প্রতিবেদন |
০১:০০ এ.এম | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫


‘বিচার চলাকালে আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু। সবাই মনে করবে আমাদের খাতির নেই।’ আওয়ামী আমলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুমকে আগে থেকেই এভাবে বলে রেখেছিলেন তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক। সোমবার শেখ হাসিনার মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে এসব কথা তুলে ধরেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। গতকাল ৪৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ টেনে মাহমুদুর রহমান বলেন, শাপলা চত্বরে গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা আল­ামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন নিজামুল হক নাসিম। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করেছিলেন তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল দৈনিক আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। নিজের বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন বিচারপতি নিজামুল হক। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ ও ইমেইল আমার দেশ ও ইকোনমিস্টের কাছে পৌঁছায়।
সেই কথোপকথনে দেখা যায়, একটি তামাশায় পরিণত হয়েছিল পুরো বিচারপ্রক্রিয়া। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল, বিদেশে থাকা জিয়া উদ্দিন ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেটি হলো, জেয়াদ আল-মালুমকে আগে থেকেই বিচারপতি নিজামুল বলতেন-বিচার চলাকালে তিনি যেন মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে অবজেকশন জানান। পরে তাকে বসিয়ে দেবেন বিচারপতি নিজামুল। ভাষাটা এমন ছিল- ‘আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু। সবাই মনে করবে আমাদের খাতির নেই।’
বিচারপতি নিজামুলের পদোন্নতির বর্ণনাও দেন আমার দেশ সম্পাদক। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এসকে সিনহার কাছে অনেকবার নিজের পদোন্নতির জন্য আবদার করেছিলেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক। জবাবে সিনহা বলেছেন, ‘পদোন্নতির আগে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে।’ কেননা তৎকালীন আইনমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সিনহার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সবমিলিয়ে স্কাইপ ও ই-মেইলে পাওয়া সব নথিই পরিষ্কার করেছিল এসব মামলার রায় পূর্ব নির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। তবে এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পদত্যাগে বাধ্য হন বিচারপতি নিজামুল। 
মাহমুদুর রহমান বলেন, পদত্যাগ করলেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন এই চেয়ারম্যানকে। উল্টো তাকে পুরস্কার হিসেবে কিছুদিনের মধ্যে হাইকোর্টে বেঞ্চ দেওয়া হয়। এরপর পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। এমনকি বিচারপতির চাকরি থেকে অবসরের পর তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। অর্থাৎ জনগণকে ফ্যাসিস্ট সরকার বুঝিয়ে দিলো যে, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার মামলায় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের দেওয়া সাক্ষ্যে বলেন সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর বিরোধী প্রতিপক্ষকে দমনে মনোনিবেশ হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতেই টার্গেট করা হয় ইসলামিক দলকে। এ পরিকল্পনামতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে বাংলাদেশে মব কালচার সৃষ্টি করা হয়। 
এ ছাড়া গতকালকের জবানবন্দিতে আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো চিত্র তুলে ধরেন মাহমুদুর রহমান। বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতির পর ফের শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
এদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আরও দু-একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম শেষ করবেন বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।