খুলনা | মঙ্গলবার | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

ফিলিস্তিনকে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ

|
১১:৫৯ পি.এম | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫


ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। গত রোববার দেশগুলো আলাদা আলাদাভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। গত জুলাই মাসে যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেয়। বলা হয়, ইসরাইল যদি ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণে রাজি না হয় এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে টেকসই শান্তি স্থাপনে চুক্তি না করে, তাহলে যুক্তরাজ্য তার অবস্থান বদলাবে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। পরবর্তী পর্যায়ে ফ্রান্স, কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও লুস্কেমবার্গ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেয়। রোববারই পর্তুগালের স্বীকৃত দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু যথাসময়ে ঘোষণা আসেনি। ফ্রান্স সোমবারের মধ্যে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে খবরে উলে­খ আছে। জানা গেছে, জাতিসংঘের অধিবেশন চলার সময়ও কয়েকটি দেশ স্বীকৃতির ঘোষণা দিতে পারে। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতির পর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়া দেশের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৫০টি। ফ্রান্সের স্বীকৃতি যুক্ত হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যর মধ্যে চারটির স্বীকৃতি নিশ্চিত হবে। বাকি থাকবে কেবল যুক্তরাষ্ট্র। প্রশ্ন উঠতে পারে, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশের স্বীকৃতির পরও কি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? না, হয়নি। বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন এমন একটি রাষ্ট্র যার অস্তিত্ব আছে, আবার নেইও। বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। অলিম্পিকের মতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেয় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষকের মর্যাদা আছে তার। কিন্তু ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী ও সেনাবাহিনী নেই। ৯০’র দশকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয় বটে, তবে পুরো ভূখন্ডের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। গাজায় এখন ইসরাইলের ভয়াবহ আগ্রাসন ও নিধন চলছে। এত দেশের স্বীকৃতির পরও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অনেকে এই স্বীকৃতিকে তথাকথিত স্বীকৃতি হিসাবে অভিহিত করেন, যা অমূলক নয়। স্বীকৃতি যদি ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব ও নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে সেই স্বীকৃতির আদৌ মূল্য থাকে না। অনেকের মতে, স্বীকৃতির এই ধারাবাহিকতা নৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে শক্তিশালী করবে। কূটনৈতিক দিক দিয়ে তার সক্ষমতা বাড়াবে। দেশের পর দেশের সংহতিজ্ঞাপন তার জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। যুক্তরাজ্যসহ তিন দেশের স্বীকৃতিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ স্বাগত জানিয়েছে। পক্ষান্তরে ইসরাইল তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে। কসাই নেতানিয়াহু হুংকার দিয়েছেন, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না।
ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইল যা কিছু করেছে, তা ওই অভিধার সত্যতাই প্রমাণ করে। ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতা ও সন্ত্রাস গত ৭৭ বছর মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির-অস্থিতিশীল করে রেখেছে। আশপাশের কোনো দেশেরই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ভূখন্ডের নিরাপত্তা নেই। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার আশংকা প্রতিনিয়ত বিদ্যমান। কিছুদিন আগে ৭২ ঘণ্টায় কাতারসহ কয়েকটি দেশে হামলা চালায় ইসরাইল। বলা বাহুল্য, এই বিষফোঁড়া কেটে ফেলা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কখনোই নিরাপদ হতে পারবে না। ওয়াকিবহাল মহলের জানা, মুসলিম বিদ্বেষী তৎকালীন পরাশক্তিগুলো একজোট হয়ে জোর করে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটায়। মূলে ছিল যুক্তরাজ্য, সঙ্গে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশ। তারও আগে ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখন্ড নিয়ে একটি ঘোষণায় সই করেন, যা বেলফোর ঘোষণা হিসাবে কুখ্যাত। এই ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য বাসস্থানের অঙ্গীকার করা হয়। ওই ঘোষণাকে ভিত্তি করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি জুটে যায়। এখন যে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলা হচ্ছে, তার মূলে আছে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। পশ্চিম তীর ও গাজার আগের যে সীমান্ত ছিল, তা নিয়ে ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বলা হয়। বাকি অংশ নিয়ে হবে ইসরাইল রাষ্ট্র। পরিতাপের বিষয়, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। না হওয়ার জন্য ইসরাইলের নারাজি, ভূমিদখল, আগ্রাসী তৎপরতা ও যুদ্ধ যেমন দায়ী, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অন্ধ ইসরাইলবাদী নীতিও দায়ী। প্রায় দু’বছর গাজায় ইসরাইল একতরফা যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই ইসরাইলি হামলায় নিহত হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। এ পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে নারী-শিশুর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ। গাজা এখন কার্যত ধ্বংস্তূপ। যারা বেঁচে আছে, তারা বারবার বাস্তচ্যুত হচ্ছে। এখন চলছে স্থল অভিযান। গাজা খালি করাই এই অভিযানের লক্ষ্য। পশ্চিম তীরে নিয়ে নেতানিয়াহুর কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন করে পশ্চিম তীর দখলের কাজ অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে ইসরাইল। পশ্চিম তীর ও গাজায় হামলা-যুদ্ধ, মানুষ হত্যা, ধ্বংসকান্ড ইত্যাদির দায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এড়াতে পারবে না। তাদের সমর্থন, অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বলেই ইসরাইল এ রকম পরোয়াহীন স্পর্ধা দেখিয়ে আসছে।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে কেউ নেই। মুসলিম বিশ্ব তথা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) তার পক্ষে দাঁড়াতে পারতো। এটা মুসলিম দেশগুলোর নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু লিপ সার্ভিস ছাড়া তারা কিছুই করছে না। তাদের ধরি মাছ, না ছুঁই পানি নীতি তাদের জন্যও বিপদের হুমকি। কাতারে ইসরাইলি হামলার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এ হামলার প্রেক্ষিতে কাতারে আরব ও ইসলামী দেশগুলোর যে সম্মেলন হয়ে গেলো, সেখানে ইসরাইলকে নিন্দাবাদ জানানোর সাথে সাথে ইসলামী দেশগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ন্যাটোর আদলে একটি ইসলামী বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রগতি কতটা হয়েছে জানা না গেলেও সউদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। ইসরাইল-ভারত প্রভৃতি দেশের এ চুক্তিতে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এর আগে বলা হয়েছিল, ইরানের পর পাকিস্তান ও তুরস্ক ইসরাইলের হামলার শিকার হতে পারে। এমতাবস্থায়, আরব, পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের সমন্বয়ে ইসরাইল বিরোধী একটা বলয় বা জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষক মহল মনে করে, আরব ও মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তার স্বার্থে এই বলয় বা জোট গড়ে তোলা জরুরি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করি। প্রসঙ্গত উলে­খ করা আবশ্যক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশ যদি আন্তরিক হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইসরাইলি আগ্রাসন ও যুদ্ধ বন্ধ করা মোটেই কঠিন নয়। কাজেই তাদের ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিই নয়, এইসঙ্গে এমন বাস্তব উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়।