খুলনা | সোমবার | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৩ আশ্বিন ১৪৩২

মেজরসহ ১৩ সেনা ও ৩ পুলিশ আহত সরকারি অফিস, বাজার, দোকান ও বসতঘরে অগ্নিসংযোগ

ধর্ষণকান্ডে খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা-সহিংসতা, নিহত ৩

খবর প্রতিবেদন |
১০:৫৯ পি.এম | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫


খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলায় সহিংসতা ও দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য এবং আরও অনেকে। জেলার গুইমারায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি অফিস, দোকান ও বসতঘরে অগ্নিসংযোগের খবরও পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। রোববার দুপুরের আগে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ। সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তিনি বলেন, গুইমারায় গুলিতে তিনজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের লাশ হাসপাতালে রয়েছে। তবে কার গুলিতে কীভাবে মারা গেছে, বিস্তারিত জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরও তিনজন আহত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের রোববার সন্ধ্যায় বলেন, গুইমারা থেকে তিনজন পুরুষের লাশ এসেছে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে। তাঁদের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। আগামীকাল সোমবার সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে গুইমারা থেকে আনা আহত চারজন চিকিৎসাধীন।
এদিকে এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 
জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসান স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ মর্মে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অতি শিগগির তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।  ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণ পূর্বক শান্ত থাকার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।  
স্থানীয়রা জানান, গুইমারার রামসু বাজারের মুখে অবরোধের সমর্থনে সড়কে গাছের গুঁড়িতে আগুন দিয়ে পিকেটিং চলছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের সরে যেতে বললে এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
অবরোধকারীরা রামসু বাজারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে সমাজসেবা অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বেশ কিছু অফিস, দোকান, বসতঘর, মোটরসাইকেল পুড়ে যায়।   পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ছোড়ে। রামসু বাজারের আশপাশের এলাকায়ও সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।  
গুইমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এনামুল হক চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি অনেকটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আতঙ্কিত না হয়ে লোকজনকে ১৪৪ ধারা মেনে চলতে বলা হয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, আমি এসপিসহ ঘটনাস্থলে অবস্থান করছি। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত আছেন।
এর আগে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’র ব্যানারে শনিবার ভোর পাঁচটা থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আজ রোববার সকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ করেন অবরোধকারীরা।
গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি ক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। ভুক্তভোগীর বাবা অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করে খাগড়াছড়ি সদর থানায় মামলা করেন।  এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’র ব্যানারে অবরোধ চলাকালে গতকাল দুপুরে গুইমারার একটি বাজারে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। এ সময় বাজারের পাশে থাকা বসতঘরও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার বেলা একটায় খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
বাজারটি চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে। বাজারে আগুন দেওয়ার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে আগুনে বাজারের দোকানপাট জ্বলতে দেখা যায়। বাজারের দোকান মালিকদের অধিকাংশ পাহাড়ি বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকা জুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল আছে। 
এর আগে দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অবরোধের সমর্থনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা যায়। এ ঘটনায় অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মংসাজাই মারমা ও কংজরী মারমা জানান, অবরোধের সমর্থনে তাঁরা খাদ্য গুদামের সামনের সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এলে তাঁদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ওপর গুলি করেন বলে অভিযোগ করেন এই দু’জন। তাঁরা বলেন, গুলির পরপরই লোকজন ভয়ে দিগি¦দিক পালিয়ে যান। এরপর ২০-২৫ জন লোক এসে রামেসু বাজার ও বসতবাড়ি লুটপাট করে এবং যাওয়ার সময় আগুন ধরিয়ে দেন। এসব লোকের সঙ্গে মুখোশ পরা লোকও ছিল। এ সময় দোকানপাট ও বসতবাড়ির সঙ্গে অনেকগুলো মোটরসাইকেলেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
খাগড়াছড়ির গুইমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ এনামুল হক চৌধুরী মুঠোফোনে জানান, অবরোধ নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও ঝামেলা হয়। এখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
এদিকে খাগড়াছড়ি শহরে রোববার সকাল থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান দেখা গেছে। বাজার ও বাজারের আশপাশে কোনো দোকানপাট খোলেনি। প্রয়োজনীয় কাজে যাঁরা বের হচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে নিরাপত্তা বাহিনী।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ জানান, খাগড়াছড়ির গুইমারা বাজারে দিনভর সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছে। এছাড়া সংঘর্ষের পর গুরুতর আহত ৫ জন গ্রামবাসীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিকেলের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
অপর দিকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনকে নিয়ে দুপুরে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখার উদ্দিন খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করে একটা পক্ষ ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি সব জাতিগোষ্ঠীকে মিলেমিশে থাকার আহŸান জানান।