খুলনা | মঙ্গলবার | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

ধর্ষণ মামলা তদন্ত প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনতে হবে

|
১২:২২ এ.এম | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫


ধর্ষণ মামলা নিয়ে পুলিশের একটি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া কিছু পরিসংখ্যান ও ঘটনার চিত্র গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দায়ের হওয়া ধর্ষণ মামলার প্রায় ৪৪ শতাংশ তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক মামলাই ‘মিথ্যা’ বা ‘তথ্যগত ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পিবিআই প্রধানের ভাষ্য অনুসারে, সব প্রমাণিত না হওয়া মামলা ভুয়া নয়। অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপরাধ সত্য হলেও তা সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে প্রমাণ করা যায়নি। বাদীর অনীহা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ, সাক্ষীদের সুরক্ষার অভাব, মামলার দীর্ঘসূত্রতা কিংবা চিকিৎসা পরীক্ষায় বিলম্ব সব মিলিয়ে অনেক সত্য ঘটনা আইনের কাঠগড়ায় টিকতে পারেনি। তদন্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ধরণগুলো লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, বিষয়টি খুব সরল নয়। কোনো কোনো ঘটনায় সত্যিকার অর্থেই ধর্ষণ করা হয়েছে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তদন্তকারী কর্মকর্তা ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ দিতে বাধ্য হন। আবার কখনো ভুল বোঝাবুঝি বা সামাজিক বিবাদ থেকে মামলা হয়, যা পরে ‘মিসটেক অব ফ্যাক্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া মামলা হলে সেটিকে ‘ফলস’ রিপোর্ট দেওয়া হয়।
সমস্যার জায়গা হলো যখন সত্য ঘটনা প্রমাণিত হয় না, তখন তা ভুয়া মামলার তালিকায় পড়ে যায়, অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার গল্প। অন্যদিকে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতাও একটি বড় সংকট। প্রতিশোধ বা ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে দায়ের করা এসব মামলায় নির্দোষ মানুষ হয়রানির শিকার হন। ভুয়া মামলা নির্দোষ ব্যক্তিদের জীবনে ভয়াবহ সংকট ডেকে আনে।
বিচার ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কেবল ভুয়া মামলা শনাক্ত করা নয়; প্রকৃত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাতেই সবচেয়ে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। নারী ও শিশু অধিকারের সংগঠনগুলো বারবার বলছে, তদন্তের দক্ষতা বাড়ানো, প্রমাণ সংগ্রহে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ছাড়া এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়।
ধর্ষণ মামলা সত্য হোক বা মিথ্যা প্রতিটি ঘটনায় প্রতিফলিত হয় আমাদের ভঙ্গুর সামাজিক পরিস্থিতি ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো উভয় ধরনের সংকট দূর করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে একদিকে নির্দোষ ব্যক্তিরা যেমন ভুয়া মামলায় ভোগান্তির শিকার হবেন, অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারাবেন, যা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। এ কারণে ভুয়া মামলার প্রবণতা বন্ধ করা যেমন জরুরি, তেমনি প্রকৃত ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব, যখন নির্দোষ মানুষকে রক্ষা করার পাশাপাশি অপরাধীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
ন্যায়বিচার শুধু আদালতের রায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজে আস্থা, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্ষণ একটি ভয়ংকর সামাজিক অপরাধ। এর শিকার ব্যক্তি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও সামাজিকভাবেও বিপর্যস্ত হন। আর যখন মামলা যথাযথভাবে প্রমাণিত হয় না, তখন অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। 
আমরা মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত প্রক্রিয়ার দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সংস্কার করা প্রয়োজন। মেডিকেল পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিলম্ব রোধ, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা এবং মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।