খুলনা | বুধবার | ১৯ নভেম্বর ২০২৫ | ৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

যেভাবে ‘শেষ’ হলো ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’র সাহসী যাত্রা

খবর ডেস্ক |
০১:১৪ এ.এম | ০৩ অক্টোবর ২০২৫


গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর লক্ষে শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। একাধিক দেশ থেকে আগত মানবাধিকার কর্মী, ত্রাণকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা সমুদ্রপথে একত্র হয়ে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সরঞ্জাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবে এক মাসব্যাপী এই অভিযাত্রা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাধা, আটক অভিযান এবং নিরাপত্তা ঝুঁঁকির কারণে থেমে গেছে।
গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙা এবং গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে প্রায় ৪৫টি জাহাজে করে গাজার দিকে রওনা দিয়েছিলেন ৫০০ অধিকারকর্মী। তবে তাদের গাজায় যেতে দেয়নি ইসরায়েল। ফ্লোটিলার বেশিরভাগ নৌযান ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী দ্বারা আটকে দেওয়া হয়। যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ধারণা করা হচ্ছে তারা সবাই বর্তমানে আটক অবস্থায় রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা অভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার এই যাত্রা গাজায় পৌঁছানোর আগে শেষ হয়ে গেছে। এসব জাহাজ আটকাতে গিয়ে কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি বলেও জানিয়েছে তারা।
এদিকে, বার্তাসংস্থা রয়টার্স আয়োজকদের বরাতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা এখন পর্যন্ত ৩৯টি জাহাজ আটক করেছে। কিন্তু একটি জাহাজ এখনও গাজার দিকে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং আটককৃত মানবাধিকার কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহŸান জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রিফিউজি বিরিয়ানি অ্যান্ড বানানাস-এর প্রতিষ্ঠাতা রুহি লরেন আখতার ছিলেন এ অভিযানের অন্যতম যাত্রী। তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানান, তাদের নৌযানটি শেষ পর্যন্ত সাইপ্রাসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, জাহাজে থাকা কয়েকজন যাত্রী “উচ্চ ঝুঁকিতে” ছিলেন এবং আটক হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
রুহি বলেন “আমরা চাই আমাদের সহযাত্রীরা যারা ইতোমধ্যেই আটক হয়েছেন তাদের জন্য সোচ্চার হতে, আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি করতে এবং গাজামুখী নৌযানগুলোর জন্য নিরাপদ করিডর নিশ্চিত করতে।”
যদিও ফ্লোটিলার প্রধান লক্ষ্য গাজায় সরাসরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া, বাস্তবায়িত হয়নি, তবুও এই যাত্রা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সংগঠকরা বলেন, “এটি কেবল একটি ত্রাণ মিশন নয়, বরং একটি বার্তা। গাজার অবরোধ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।”
ইউরোপীয় গ্রিন পার্টি ইতোমধ্যে ইসরায়েলের এই আটক অভিযানে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং একে “আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করেছে। তারা জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহŸান জানিয়েছে আটক যাত্রীদের মুক্তি ও মানবিক সহায়তার নিশ্চয়তা দিতে।
গাজা উপত্যকার উদ্দেশে যাওয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা বহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আক্রমণ করে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। এ সময় অন্তত ৩১৭ জন অধিকারকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন ফ্লোটিলার আয়োজকেরা। তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি এ তথ্য জানিয়েছে।
অফিশিয়াল ফ্লোটিলা ট্র্যাকার জানিয়েছে, ২১টি জাহাজে হামলা চালায় ইসরায়েলি নৌবাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, আরও ১৯টি জাহাজে হামলা হয়েছে। এর বাইরে চারটি জাহাজ এখনো গাজা অভিমুখে যাত্রা করছে। তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েল অন্তত ৩৯টি জাহাজ আটক করেছে।
ট্র্যাকার আরও জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী ২১টি জাহাজ থেকে অন্তত ৩১৭ জন কর্মীকে আটক করেছে। ইসরায়েলের আক্রমণের শিকার হওয়া জাহাজগুলোর কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- স্পেন, ইতালি, ব্রাজিল, তুরস্ক, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নাগরিকসহ আরও অনেক দেশের নাগরিক।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে তাঁদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে।
এদিকে অফিশিয়াল ট্র্যাকার দেখিয়েছে, ‘মিকেনো’ নামের জাহাজটি গাজার আঞ্চলিক জলসীমায় প্রবেশ করেছিল। তবে প্রায় ৯ দশমিক ৩ নটিক্যাল মাইল দূরে পৌঁছানোর পর জাহাজটির ট্র্যাকিং সিগন্যাল হারিয়ে যায়। তুরস্কের কর্মী এরদেম ওজভেরেন জানান, তাঁদের জাহাজ গাজা থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইলেরও কম দূরে, অর্থাৎ প্রায় ৫৫ কিলোমিটার ব্যবধানে ছিল।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা জানায়, গাজার দিকে এগিয়ে যাওয়া অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনী জাহাজগুলো ঘিরে ফেলে। এর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিনের অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিল। কর্মীরা জানান, বেশির ভাগ জাহাজেই সিগন্যাল বিঘœ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ইসরায়েল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকজন অধিকারকর্মী একাধিক ভিডিও প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর নৌযান বহরের কাছে গিয়ে তাঁদের দিক পরিবর্তনের নির্দেশ দিচ্ছে।
গাজা অবরোধ ভাঙতে রওনা হওয়া সুমুদ ফ্লোটিলা এক্সে লিখেছে, ‘আমাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে জায়নিস্ট সেনারা। কয়েকটি জাহাজ আটকের পর সব জাহাজে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। আমাদের জাহাজগুলো অবৈধভাবে আটকানো হচ্ছে। ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেছে, সেনারা জাহাজে প্রবেশ করেছে।’
কমিটির অভিযোগ, ইসরায়েলি নৌবাহিনী কর্মীদের ওপর সহিংসতা চালিয়েছে। তারা একটি জাহাজে ধাক্কা মেরেছে, জলকামান ব্যবহার করেছে এবং জোর করে জাহাজে উঠেছে। একই সঙ্গে ৫০টি দেশের শান্তিপ্রিয় কর্মীদের ‘নির্মমভাবে’ নির্যাতন করা হয়েছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, কিছু কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের একটি ইসরায়েলি বন্দরে নেওয়া হবে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নৌবাহিনীকে ফ্লোটিলায় পৌঁছে কর্মীদের আশদোদ বন্দরে যেতে বলা হয়েছে। সেখানেই জাহাজগুলো পরীক্ষা করা হবে, তারপর সাহায্যসামগ্রী গাজায় পাঠানো হবে। 
উলে­খ্য, ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা যাত্রা শুরু করে। তার পরের ধাপে অন্যান্য নৌযানগুলি ৪ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়া ও সিসিলি থেকে যোগ দেয়। এতে মূলত মানবিক সাহায্য ও চিকিৎসাসামগ্রী ছিল। বহু বছর পর একসঙ্গে ৫০টির বেশি জাহাজ গাজার উদ্দেশে যাত্রা করে। এতে ৪৫টির বেশি দেশের ৫৩২ জন বেসামরিক সমর্থক ছিলেন। প্রায় ১৮ বছর ধরে গাজায় অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। চলতি বছরের মার্চে তারা সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশ বন্ধ করে অবরোধ আরও কঠোর করে। এতে পুরো অঞ্চল দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে।
উলে­খ্য, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর বেশির ভাগই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, গাজা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনাহার আর রোগব্যাধি।