খুলনা | মঙ্গলবার | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

ডেঙ্গু মোকাবিলায় জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন

|
১১:৪১ পি.এম | ০৫ অক্টোবর ২০২৫


ডেঙ্গুর ভীতিকর অভিজ্ঞতার সঙ্গে বসবাস ২৫ বছরের বেশি সময় হলেও এখন পর্যন্ত এই রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারাটা যারপরনাই হতাশাজনক। এটি নিঃসন্দেহে সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো সমস্যা সমাধানে আমাদের জাতিগত যে ব্যর্থতা, তারই বহিঃপ্রকাশ। ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিপর্যয় এবং কোভিড মহামারির দুই বছর ছিল আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বড় এক সতর্কবার্তা। কিন্তু ইতিহাসের একমাত্র শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ কখনো শিক্ষা নেয় না-এই অপ্রাপ্তবাক্যকে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যে ব্যতিক্রমহীনভাবে সত্যে পরিণত করতে জানেন, এ বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ দিচ্ছে।
তুলনামূলক বিচারে গত বছরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ, পাল­া দিয়ে মৃত্যুর হারও বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু আশঙ্কা এখানেই শেষ হচ্ছে না। আগের অভিজ্ঞতা বলছে, অক্টোবর মাসের আবহাওয়া ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময়। কীটতত্ত¡বিদেরাও সতর্ক করছেন, এখন এডিস মশার যে ঘনত্ব, তাতে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ও সর্বোচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে হলে এই মুহূর্তেই কঠোর, জরুরি ও সম্মিলিত পদক্ষেপের বিকল্প পথ খোলা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। মারা গেছেন ১৮৯ জন। জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, এবারে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ দু’টি। এক. আক্রান্তরা দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ফলে শক সিনড্রোমসহ নানা শারীরিক জটিলতা নিয়েই তাঁরা হাসপাতালে আসছেন। দুই. উপজেলা ও জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে জটিল রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদের ঢাকায় যেতে হচ্ছে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গুর আরেকটি বড় সংকট হলো চিকিৎসা ব্যয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশ রোগীকে যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। ডেঙ্গু চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনেক পরিবারকে শুধু হিমশিম খেতে হচ্ছে না, ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়তে হচ্ছে। অনেক পরিবারের জন্য এটা দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চাপ তৈরি করছে। দেরিতে হাসপাতালে ভর্তির পেছনে এটাও একটা বড় কারণ হতে পারে। ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে ডেঙ্গু ও পারিবারিক ট্র্যাজেডির আরেকটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে হঠাৎ করেই প্রিয়জন কিংবা স্বজনের মৃত্যু একেকটা পরিবারের জন্য যে দুঃসহ শোক ও ক্ষতের জন্ম দিচ্ছে, তা একেবারেই অমোচনীয় ও অপূরণীয়। আর কোনো পরিবারকে যাতে এ রকম ভয়াবহ ট্র্যাজেডি’র মুখোমুখি না হতে হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারগুলোর। কিন্তু সেই দায় কতটা তারা অনুভব করতে পারে, সেটা সব সময়ই বড় প্রশ্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটা সুযোগ ছিল এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় যে বিচ্ছিন্ন ও খাপছাড়া উদ্যোগ চলে আসছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সমন্বিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার। কিন্তু এখানেও আগের ব্যর্থতার ধারাবাহিকতাটাই দেখা গেল।
আমরা মনে করি, অক্টোবরে ডেঙ্গু সংক্রমণ যাতে ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাতে না পারে, তার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে এখনই একযোগে কাজ করা জরুরি। নাগরিকদের সম্পৃক্ত না করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হতে পারে না।