খুলনা | সোমবার | ২০ অক্টোবর ২০২৫ | ৫ কার্তিক ১৪৩২

জন্ম থেকে জন্মান্তরে কৃতকর্মে ও কালজয়ী আদর্শে বেঁচে থাকবেন হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী

কাজী আবুল বাশার |
১২:৩৩ এ.এম | ২০ অক্টোবর ২০২৫


মানুষ মরণশীল। জন্ম হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এটাই বিধির বিধান। পৃথিবী একটা বিচিত্রময় রঙ্গমঞ্চ। আর বিচিত্রময় দুনিয়ায় ভাল-মন্দ সব মিলিয়ে নানা ছলনায় ভরপুর মানুষ। কর্মের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে অনন্তকাল। এক কথায় সৎ কর্মেই তাঁর শেষ পরিচয়। একজন মানুষ আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার কেউ সমাজের কাছে ঘৃণাভরে প্রত্যাক্ষিত হয়।
দু’দিনের দুনিয়া। তদুপরি মহান আল­াহপাক মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এই সর্বশ্রেষ্ঠ জীবকে জীবনী শক্তি দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সহ আল­াহপাক নির্দেশিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। সুতরাং কর্মেও মাধ্যমে একজন মানুষ ইহকাল ও পরকালের সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনে।
আমার চোখে দেখা। এমন একজন মানুষ যিনি সর্ব শ্রদ্ধেয় সবার আপনজন প্রিয় স্যার হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী। যিনি সমাজের কাছে আজ স্মরণীয় এবং বরণীয়। তিনি একজন সফল শিক্ষাবিদ। তিনি সর্ব স্বীকৃত আলোকবর্তিকা এক কীর্তিমান মানুষ। আর এই কীর্তিমানদের কখনও মৃত্যু হয় না। তিনি বেঁচে আছেন আমৃত্যু মানবের মাঝে; আপন মহিমায়। প্রতি বছর মৃত্যুবার্ষিকীতে মানুষপটে ভেসে ওঠে হৃদয় থেকে তাঁর প্রতি অসংখ্য শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। যাকে সহজে ভোলা যায় না। তিনি স্মৃতিতে অম্লান দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের কাছে আজও।
হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী খুলনা জেলার তৎকালীন বৃহত্তর পাইকগাছা থানা (আজকের কয়রা) উপজেলার বাগালি গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে ২ জুলাই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছোটবেলা থেকে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এক অজপাড়াগা। বলা যায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক বিস্তীর্ণ জনপদ। চরম বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে তখনকার দিনে তাঁকে করতে হয়েছে লেখাপড়া।
আর সেই যুগে খুলনার দক্ষিণ জনপদে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে ছিল না ভালো শিক্ষা কোন প্রতিষ্ঠান। তাই তিনি তাঁর মরহুম পিতার অদম্য আগ্রহে চলে আসেন আপন জেলা শহর খুলনায়। শুরু করেন লেখাপড়া।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে মেট্রিক, ১৯৫৪ সালে হিন্দু একাডেমি আজকের (বি.এল কলেজ) থেকে আই.এ, ১৯৫৮ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ;১৯৭৪ সালে বি,এড এবং জীবনের বেলা শেষে চাকুরীর সুবাদে ১৯৯১ সালে রাজশাহী টিচার্র্স ট্রেনিং কলেজ থেকে এম.এড পাশ করেন।
তিনি চির অবহেলিত পাইকগাছা-কয়রা অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সু প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘পাইকগাছা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে’ হেডমাস্টার হিসেবে যোগদান করেন। তখনকার দিনে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করে। যেখানে ছিল গুণধর আক্ষরিক অর্থে বলা যায় সব শিক্ষকরা পন্ডিত। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী তাঁর হাতে গড়া। কৃতিত্ব অর্জনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা আজ দেশে বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, রাখছেন।
কেউ আজ সচিব, কেউ প্রধান বিচারপতি, কৃষিবিদ, শিক্ষক, জজ, ডিসি, ব্যারিস্টার, ইউএনও, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিদগ্ধ আইনজীবী ও রাজনীতিক। তারা দেশ গঠনে সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করেছে। এখনও কেউ করছে।  দেখেছি এ প্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতির জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রাবাসে,এমনকি পায়ে হেঁটে,লঞ্চযোগে তখনকার দিনে বৃষ্টি কাঁদা উপেক্ষা করে নিয়মিত কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করতে আসতেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানে এ সুযোগ্য স্যারের কাছে  লেখাপড়া করার। আমি ও বন্ধুরা মিলে কখনো গদাইপুর থেকে কদামক্ত রাস্তায় পায়ে হেঁটে, সাইকেলে করে এবং লঞ্চযোগে ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে স্কুলে যেতাম। স্মৃতিপটে ভেসে উঠে বৃষ্টি কাদার দিনে জমির গাজীর বাড়ির সন্নিকটে ধোপার বাড়ির সম্মুখে কাদায় পা আটকে যেত। কখনো আবার বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় পরিধেয় জামা-কাপড শুকিয়ে নিতে হতো। অতিরিক্ত বৃষ্টির দিনে বোয়ালিয়া লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চযোগে পাইকগাছা স্কুলে যেতাম। স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলি আজও মনে পড়ে।
স্যার আমাকে ‘কাজী সাহেব’ বলে ডাকতেন। আমার পিতাকেও ব্যক্তিগতভাবে স্যার ভালোভাবে চিনতেন। আমার মনে হয়েছিল স্যার আমাকে অন্যদের থেকেও বেশি ভালবাসতেন। আসলে সত্যি কথা বলতে গেলে তিনি সবাইকে ভালবাসতেন। প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। এখানেই স্যারের সার্থকতা এবং জীবনের ব্যাপক সফলতা।
তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া, শৃঙ্খলা ও সততায় বিশ্বাসী ছিলেন। লেখাপড়া, শৃঙ্খলার প্রতি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। কোন রকম অবহেলা বা গাফিলতি তিনি বরদাস্ত করতেন না। স্যারের সহযোগী সকল শিক্ষকমন্ডলী ছিলেন সকল বিষয়ে পারদর্শী। তারাও ছিলেন আমাদের গুণধর শিক্ষকমন্ডলী। পাইকগাছা হাই স্কুল ছিল যেন স্যারের বাড়ী। তিনি নিজস্ব বাসভবনের দিকে না তাকিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ফুলের বাগানের মত করে সাজিয়ে তুলেছিলেন।
ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রাবাসে কেমনভাবে লেখাপড়া করছে, না করছে তা তিনি রাত জেগে দেখভাল করতেন। কোন রকমের গাফিলতি তিনি বরদাস্ত করতেন না। এমনি সফলতার নিদর্শন তিনি  দেখিয়েছেন।
স্বাধীনতা উত্তর বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানটি তিনি নতুন সংস্করনেণ রূপদেন। তাই তাকে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি’র রূপকার বলা হয়। সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য নাবিক যেমন আরোহীদের সুখে-দুঃখে, জীবন-মরণ সমস্যার অবলম্বন, ঠিক তেমনি ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের পার্শ্বে তিনি ছিলেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র অবলম্বন।
আজাদ বার্তা পত্রিকা ছিল তার অনবদ্য সৃষ্টি। আমি গর্বিত যে স্যারের স্মৃতি বিজড়িত পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে পেরে। স্যারের নামে গর্বিত পিতার সন্তানেরা “আমজাদ আলী স্মৃতি পাবলিক লাইব্রেরি” সহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এসব সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্যার আমাদের মাঝে আজও বেঁচে আছেন।
স্যারের মতো প্রতিদিন এমন নিঃস্বার্থ শিক্ষকদের খুঁজি। সেই প্রাণপ্রিয় মুখগুলিকে খুঁজি। কিন্তু কোথায় তারা। তারা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে। সে তারা এখনও রাতে আলোর মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের আলোকিত পথ দেখানোর অপেক্ষা করে। কিন্তু আমরা তো স্বার্থপর হয়ে গেছি। সবাই আর শিক্ষক নেই, কেউ কেউ শিক্ষক। এক দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়ে গেছে শিক্ষকদের প্রকৃত সত্তা। শিক্ষকতা পেশা নয়,এটা একটা আত্মত্যাগ। এটা একটা সেবা। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। ছাত্রদের মুখগুলো দেখে কষ্ট লাগে। ওরা ওদের প্রতিভার আলো ছড়িয়ে আলোকিত হতে চায়। কিন্তু শিক্ষক নামের সেই নিঃস্বার্থ মানুষটা তো আর নেই। সব  যেন দুঃস্বপ্ন, সব যেন গন্তব্যহীন।
নিভে গেলো আলোকিত একজন মানুষের জীবন। নিজের জীবন তুচ্ছ ভেবেছেন সন্তানতুল্য ছাত্রদের জন্য। এমন শিক্ষক কি এখন আর আছে। যিনি পরিবারের কথা ভাবেননি। নিজের স্বার্থের কথা ভাবেননি। সব সময় ভেবেছেন ছাত্রদের কল্যানের কথা। মৃত্যু মানুষটির প্রাণ কেড়ে নিলেও, কেড়ে নিতে পারেনি তার কালজয়ী সত্তাকে। ইতিহাস এই মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষটিকে গড়েনি বরং তিনিই  ইতিহাসকে গড়েছেন।
আজ আর নয় পথিক তুমি যাত্রা করো তোমার গন্তব্যস্থলে। মরেও তিনি আমাদের মাঝে অমর। আজকের দিনে ২০ অক্টোবর ২০১২ বাংলা ৫ই কার্তিক ১৪১৯ ৭-৩ মি. সময় ৭৮ বছর বয়সে তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। তার মৃত্যুর সংবাদে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন শুভাকাক্সক্ষী তাকে এক নজরে  দেখার জন্য পাইকগাছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে হাজির হন। সে এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি। জোহরবাদ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণ সভা সহ প্রতিষ্ঠানটি একদিনের ছুটি ঘোষণা করে। তাকে পাইকগাছা সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেখানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আমাদের চোখে আজও তিনি  বেঁচে আছেন।
একজন সমাজ সংস্কারক, দক্ষ হেডমাস্টার, সফল অধিনায়ক, স্নেহ ভালবাসার গার্জিয়ান, একনিষ্ঠ সংগঠক, মানুষ গড়ার সফল কারিগর। সুতরাং তিনি মরেও অমর। তিনি আজ বেঁচে নেই, তবে তার রেখে যাওয়া অমর কীর্তি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আমরণ।
আমরা এই আদর্শ সমাজ রূপকারকে স্মরণ করি, বরণ করি। তিনি কর্মে চিরঞ্জীব। তিনি বেঁচে আছেন মানবের মাঝে জন্ম হতে জন্মান্তরে রেখে যাওয়া কৃতকর্মে ও আদর্শে। এ দিবসে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে শ্রদ্ধেয় স্যারের জন্য দোয়া ও বেহেশতবাসীর দরখাস্ত করি। আমিন।  
লেখকঃ উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিক।