খুলনা | বুধবার | ২২ অক্টোবর ২০২৫ | ৭ কার্তিক ১৪৩২

একমাস আগেই হত্যার পরিকল্পনা করে মাহি ও বর্ষা : পুলিশ

‘হত্যাকান্ডস্থলে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন জুবায়েদ, মন গলেনি বর্ষার’

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৯ এ.এম | ২২ অক্টোবর ২০২৫


রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা মোঃ জোবায়েদ হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা প্রায় এক মাসে আগেই করেছিল তাঁর ছাত্রী ও তার বন্ধু মাহির রহমান। মাহিরের ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান জোবায়েদ। এই হত্যাকান্ডের সময় সরাসরি উপস্থিত ছিলেন তার ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা (১৯)। তবে মৃত্যুর আগে জোবায়েদ তাঁর ছাত্রীর কাছে শেষ মুহূর্তে বাঁচার আকুতি জানান। এ সময় জোবায়েদকে ছাত্রী বলে, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হতে পারব না।’ এর কিছু সময় পরই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান জোবায়েদ। হত্যায় অংশ নেয় বর্ষার প্রেমিক মোঃ মাহির রহমান (১৯) ও তার বন্ধু ফারদিন আহমেদ আয়লান। ঘটনাটি ঘটে গত রোববার (১৯ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নূরবক্স লেনের রৌশান ভিলায়।
‎মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এ্যান্ড অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম ও ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী। ‎
জানা গেছে, বর্ষা ও মাহির দীর্ঘ ৯ বছরের প্রেমের সম্পর্কে ছিল। কিন্তু কিছু সময় পর বর্ষা তার শিক্ষক জুবায়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং মাহিরকে সম্পর্ক থেকে সরে যেতে বলেন। পরে আবার বর্ষা মাহিরকে জানান, তিনি জুবায়েদকে আর ভালোবাসেন না। সম্পর্কের এই জটিলতায় ক্ষিপ্ত হয়ে মাহির ও বর্ষা মিলে জুবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মাহির একই ভবনে ভাড়া থাকতেন। মাহির ও ওই ছাত্রীর দীর্ঘদিনের পরিচয়। তবে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে দেড় বছর আগে। জোবায়েদ এক বছর ধরে ওই মেয়েকে পড়াতেন। পড়ার সময় জোবায়েদের প্রতি দুর্বল হয়ে যায় সে। এমন অবস্থায় মাহিরকে ওই ছাত্রী বলে, ‘জোবায়েদকে না সরাতে পারলে আমি তোমার হতে পারব না।’ এভাবেই তারা জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ‎
পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই ছাত্রী একই সময়ে তার গৃহশিক্ষক জোবায়েদ ও মাহিরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। গত ২৬ সেপ্টেম্বর মাহির বিষয়টি নিয়ে মেয়েটিকে চাপ প্রয়োগ করলে সেদিনই গৃহশিক্ষক জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। পরে মাহির ও তাঁর বন্ধু আইলান চাকু কিনে গত রোববার (১৯ অক্টোবর) ওই মেয়ের বাসার নিচে অবস্থান নেন। আর মেয়েটি তার শিক্ষক জোবায়েদকে ডেকে আনে। এরপরই মেয়েটির বাসার সিঁড়িঘরে মাহির জোবায়েদকে বলেন, ওই ছাত্রীকে যেন ভুলে যান। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হলে জোবায়েদ বলেন, ‘সে তো আমাকে পছন্দ করে।’ একপর্যায়ে জোবায়েদকে চাকু দিয়ে গলায় পোচ দেন মাহির।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মল্লিক আহসান সামী জানান, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা চলছিল। বর্ষা ও মাহির মিলে এই পরিকল্পনায় যুক্ত হয়। হত্যার দিন মাহির ও আয়লান দুইটি নতুন সুইচ গিয়ার ছুরি কিনে। বিকেলে রৌশান ভিলার নিচতলায় এসে মাহির ও আয়লান মিলে জুবায়েদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় জুবায়েদ প্রাণ বাঁচাতে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার দিকে ওঠার চেষ্টা করেন। সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে রক্তের দাগ পাওয়া যায়। তিনতলায় উঠে পড়লেও তখন তিনি আর হাঁটতে পারেননি। ওই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন বর্ষা। সিঁড়িতে দেখা হওয়ার সময় জুবায়েদ তাকে বলেন, আমাকে বাঁচাও। তখন বর্ষা জবাব দেন, ‘তোমাকে না মারলে আমি মাহিরের হবো না।’ এরপর মাহির আবার ছুরি নিয়ে এসে জুবায়েদের গলার ডান পাশে আঘাত করে। হত্যার পর মাহির দ্রুত পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আয়লানকে বলে ছুরিটি তুলে আনতে। ঘটনার পরে মাহির তার বন্ধু প্রিতমের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে।
মল্লিক আহসান বলেন, জোবায়েদের প্রতি বেশি দুর্বলতা থাকলেও মেয়েটি একই সঙ্গে মাহির ও জোবায়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। ত্রিভুজ প্রেম থেকে বের হতে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা সাজায় মেয়েটি।
মাহিরকে তাঁর মা থানায় হস্তান্তরের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে আসামি গ্রেফতারে পুলিশের নানা ধরনের কৌশল থাকে। আগে চট্টগ্রামের রাউজানে নিয়মিত শিক্ষার্থী অপহরণ হতো, মুক্তিপণ আদায় করা হতো। আমরা তখন অপহরণকারীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে তাদের ব্যবহার করে সমঝোতার চেষ্টা করতাম। ঠিক এভাবেই আমরা মাহিরকে থানায় দিয়ে যেতে চাপ প্রয়োগ করেছি। এটা আমাদের কৌশলের অংশ। স্বেচ্ছায় থানায় হস্তান্তর করা হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, হত্যার পুরো পরিকল্পনা করেছে মেয়েটিই। বরগুনার মিন্নির ঘটনার সঙ্গে অনেকাংশ মিল রয়েছে। মেয়েটা দু’জনের কারও কাছ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ফলে সে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা সাজায়।
পুলিশ জানায়, হত্যার সময় বর্ষা শুধু উপস্থিত ছিলেন না, পুরো পরিকল্পনাতেই সে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। জুবায়েদের সঙ্গে তার মাত্র তিন মাসের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই সময়েও বর্ষা মাহিরের প্রতি টান ছাড়তে পারেননি। বর্ষা নিজের গহনা বিক্রি করে মাহিরকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেন, যেটি দিয়ে মাহির একটি মোটরবাইক কেনে।
নিহত জুবায়েদ কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি গত এক বছর ধরে বর্ষাকে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়াতেন।
হত্যাকান্ডের পরে শিক্ষার্থীরা বংশাল থানার সামনে বিক্ষোভ করে এবং তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করে রাখে। ঘটনার দিন রাতেই পুলিশ আরমানিটোলার বাসা থেকে বর্ষাকে হেফাজতে নেয়। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়।
ঘটনার পরদিন জুবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত বংশাল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় বর্ষা, মাহির, আয়লানসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা তিনজনকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী, তার বন্ধু মোঃ মাহির রহমান ও তাঁর বন্ধু ফারদিন আহমেদ আইলানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ‎
মামলার বাদী এনায়েত হোসেন সৈকত বলেন, আমরা চাচ্ছি প্রকৃত অপরাধীরা যেন শাস্তি পায়, নির্দোষ কেউ যেন ফেঁসে না যায়। পুলিশকে ধন্যবাদ, তারা সব আসামিকে ধরতে পেরেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তাজাম্মুল হক বলেন, আমরা দ্রুততম সময়ে স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক বিচার চাই। অপরাধী যেই হোক, প্রমাণের ভিত্তিতে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।