খুলনা | রবিবার | ০২ নভেম্বর ২০২৫ | ১৭ কার্তিক ১৪৩২

অক্টোবরে বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশ ও কারা হেফাজতে মৃত্যু: এমএসএফ

খবর প্রতিবেদন |
১২:১২ এ.এম | ০১ নভেম্বর ২০২৫


দেশে কারা হেফাজতে মৃত্যু ও অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে বেশ খানিকটা বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। গতকাল শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।

এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাক্সিক্ষতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দি ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এক শিশু, এক কিশোর, ১১ নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাত বছর বয়সি শিশু; ১৫ বছর বয়সি কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সি ১৫ জন পুরুষ ও দুজন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সি ১৯ জন পুরুষ ও ছয়জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সি এক নারী ও পাঁচজন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।

এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে এর সংখ্যা ছিল মোট ৮। গত মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দি মারা যান। সব বন্দির মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।

সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।

অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে দুইজন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী-সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল। সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকা- এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪২টি। সেপ্টেম্বরে ঘটেছিল ৪৩টি। গত মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ২ জন ছিনতাইয়ের  অভিযোগে, ৪ জন চুরির সন্দেহে, একজনকে ধর্ষণের অভিযোগে, দুজনকে ডাকাতি সন্দেহে, একজনকে সালিশে হত্যা করা হয়। অপরদিকে ১৫ জনকে চুরির অভিযোগে, ৩ জনকে ডাকাতির অভিযোগে, ২ জনকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, একজন যৌন হয়রানির অভিযোগে, তিনজনকে নিষিদ্ধ লীগের নেতাকর্মী হওয়ার অভিযোগে এবং সন্দেহজনক চুরি, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা, অপহরণ এ ধরনের অপরাধজনিত কারণে ২৬ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।

এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আইনকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটিয়ে গুরুতর আহত করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে গণপিটুনির সাথে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।

অক্টোবরে ৩৬৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় ৭টি বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৭২টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৪টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৭টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী।

এমএসএফ জানায়, ধর্ষণের শিকার ৭২ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ২১ জন কিশোরী রয়েছে, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ৯ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ২ জন শিশু, ২ জন কিশোরী ও ৩ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৯টি, যৌন হয়রানি ২৪টি, শারীরিক নির্যাতনের ৫৭টি ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে ১৩ জন কিশোরী ও ২৪ জন নারীসহ মোট ৩৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩ জন কিশোরী ও ১ জন নারী অপরদিকে ২ জন শিশু, ৫ জন কিশোরী ও ৪ জন নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়াও অক্টোবর মাসে ২ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ৪ জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৯৮ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ৩১ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছেন।