খুলনা | সোমবার | ০৩ নভেম্বর ২০২৫ | ১৯ কার্তিক ১৪৩২

তিন হাজারের বেশি গ্রাহক দিশেহারা

ডুমুরিয়ায় সমিতির ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ভারতে পালিয়েছে সুদখোর রঞ্জন মন্ডল

ডুমুরিয়া প্রতিনিধি |
১১:৫৬ পি.এম | ০২ নভেম্বর ২০২৫


তিন হাজারের বেশি গ্রাহকের সঞ্চিত প্রায় ২০ কোটি টাকা পরিশোধ না করেই রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাজিডাঙ্গা আদর্শ গ্রাম উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি রঞ্জন কুমার মন্ডল। ভুক্তভোগীরা বলছেন, রঞ্জন গ্রাহকদের সমুদয় টাকা পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা মূল্যবান জায়গা জমি লিখে নেওয়ার পর তাকে বাধ্য করেছেন স্বপরিবারে ভারতে পাড়ি জমাতে। পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন ডুমুরিয়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসে ৫ দলিলে লিখে নেওয়া হয় এসব জমি।
দলিল হওয়া জমির মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলা সদরে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের সাথে গুরুত্বপূর্ণ খান বাবুর মোড়ে এক একর ১৫ শতক জমি নিয়েছেন বিএনপি নেতা মোল­া মোশারফ হোসেন মফিজ। এই জমির দাম প্রায় চার কোটি টাকা। সদর ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম খানের ছেলের নামেও দলিল হয়েছে। আড়াই মাস আগের এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা নানা জায়গায় ধর্ণা দিয়েও টাকা ফেরৎ না পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।
ইউএনও’র কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, সমিতিতে ৩ হাজারের অধিক সদস্য বিভিন্ন মেয়াদে টাকা জমা রেখেছেন। অধিকাংশ সদস্যের বইয়ে স্কিমের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকের কিছু মাস বাকি আছে। স্কিম শেষ হওয়া গ্রাহকরা পাওনা টাকা চাইতে গেলে সমিতি কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে সময়ক্ষেপণ করে। গত ১৩ আগস্ট সমিতি অফিসে গিয়ে পাওনা টাকা চাইলে রঞ্জন মন্ডল জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করবে বলে জানান। কিন্তু পরের দিন প্রভাবশালী কিছু লোক একটি কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে করে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে রঞ্জন মন্ডলকে নিয়ে যায়। এরপর হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে সাব রেজিস্ট্রারের সামনে নেওয়া হয়। পরে বিএনপি নেতা মোল­া মোশাররফ হোসেন মফিজ, শান্তনু রায়, সাইফুর রহমান খান, গোবিন্দ মন্ডল এবং অসীম মন্ডল তার কাছ থেকে জমি লিখে নেয়।
এ সংবাদ পেয়ে গ্রাহকেরা রঞ্জনের বাড়ি গেলে তিনি জানান, জমি লিখে দিলেও কেউ আমাকে এক টাকাও দেয়নি। ওরা আমাকে আগামীকাল (১৫ আগস্ট) সকালে টাকা দেবে। আপনারা সকালে আসেন, টাকা দিয়ে দিব। যথাসময় আমরা সমিতি কার্যালয় উপস্থিত হলে জানতে পারি, রঞ্জন মন্ডল ঐদিন ভোর রাতে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা সদরের থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনের মাঝামাঝি খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের গায়ে রঞ্জনের মালিকানাধীন এ অঞ্চলের একমাত্র আট তলা ভবনে হাজিডাঙ্গা আদর্শ গ্রাম উন্নয়ন বহুমুখি সমবায় সমিতি লিমিটেডের নিজস্ব অফিস। এক সময় ডুমুরিয়া বাজারে তৃষ্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডার পরিচালনা করতেন তিনি। ব্যবসায় বেশ পরিচিতি থাকলেও মিষ্টি বিক্রির আড়ালে ২০০৫ সালের দিকে সমিতি খুলে সুদের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠলে সমবায় অফিসের নিবন্ধন পান। একদিকে সমবায়ের নিবন্ধন পাওয়া, অন্যদিকে একের পর এক জমি কেনা ও সম্পত্তি বাড়ানো দেখে গ্রাহক বাড়তে থাকে সমিতির। সমিতির নামে ১০টি যাত্রীবাহী বাস কেনেন। সমিতিতে গ্রাহকের কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা জমা হয়। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীকে চড়া সুদে মোটা অংকের টাকা ঋণ দিতেন। তবে ৫ আগস্টের পর প্রায় সবাই ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এতে সঞ্চয়ী গ্রাহকের আমানত ফেরৎ দিতে চাপে পড়েন রঞ্জন।
জমা বই হাতে নিয়ে প্রায় দিনই সমিতি অফিসের সামনে হাজির হন তরুণ বিশ^াস, শম্পা, বাসন্তী, হরিদাস ফৌজদার, দীপংকর কুমার, প্রেমদাস, পুষ্প রাণী, শর্মিলা রায়সহ অনেকেই। এক-দেড় লাখ থেকে ১৬/১৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে তাদের। অনিশ্চয়তা, হতাশা, দুঃশ্চিন্তায় অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, জমি জায়গা যারা লিখে নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে, এই আটতলা বাড়ির ভাড়া ওঠে মাসে ৬০ হাজার টাকা- তা থেকে এবং আরও যেসব সম্পত্তি আছে, একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরৎ দেওয়া সম্ভব। শুধু প্রশাসনকে একটু আন্তরিক আর উদ্যোগী হতে হবে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিএনপি নেতা মোল­া মোশারফ হোসেন মফিজ সাংবাদিকদের কাছে জমি কেনার কথা স্বীকার করে বলেন, জমির দাম ৮০/৯০ লাখ টাকা। আমার কাছ থেকে ৪০/৪৫ লাখ টাকা নিয়েছে রঞ্জন। বাকি টাকা আমি সমিতির পাওনাদারদের পরিশোধ করবো বলে কথা হয়েছে। আড়াই মাসে কয়জনকে টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, এখনো কাউকে দিইনি, শিগগিরই দেওয়া শুরু করবো। তার বিরুদ্ধে একটা পক্ষ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে মফিজ বলেন, দলের ভেতর থেকে শত্র“তা করে তার নামে বদনাম করা হচ্ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আল আমিন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এটা খুব বড় একটা ইস্যু। অনেক মানুষ এর সাথে জড়িত। সমিতির নামে অনেক জায়গা জমি আছে, সম্পত্তি আছে। একটা কমিটি গঠন করে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরৎ দেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা করছি। তিনি বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তা আটকানো যায়না। তবে যারা কিনেছেন তাদের সাথে আলোচনা করে কিছু করা যায় কিনা দেখা হবে।