খুলনা | শুক্রবার | ০৭ নভেম্বর ২০২৫ | ২৩ কার্তিক ১৪৩২

“আমি জিয়া বলছি”

অ্যাড. এম মাফতুন আহমেদ |
০২:৫৩ এ.এম | ০৭ নভেম্বর ২০২৫


জিয়াউর রহমান। একজন কিংবদন্তী রাষ্ট্রনায়ক। স্বাধীনতার মহান ঘোষক; বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা। খাঁটি দেশপ্রেমিক। জাতির অগ্রগতির পথিক। তিনি গড়তে চেয়েছিলেন প্রকৃত অর্থে সোনার বাংলা। স্বনির্ভর উৎপাদনমুখী স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত একটি নতুন বাংলাদেশ।
রাত নেই, দিন নেই একজন রাষ্ট্রনায়ক টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পাটুরিয়া থেকে শিবসা, নদী বেষ্টিত এ জনপদের মানুষকে সেদিন জাগিয়ে তুলেছিলেন। আত্মনির্ভরশীল একটি জাতি হিসেবে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্য! তাঁর শাসনামলে একের পর এক ষড়যন্ত্র। বারবার অভ্যুত্থান। পাল্টা অভ্যুত্থান। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং তাদের বশংবদরা চায়নি বাংলাদেশ এই তল্লাটে জেগে উঠুক। স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে পতাকা পত পত করে উঠুক। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকুক, কোন দৃঢ় ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি থাকুক এটা ভারত চাইনি। তাই জিইয়ে রেখেছিল অভ্যন্তরীণ একের পর এক নানা সংকট।
ঘটতে থাকে সদ্য প্রস্ফুটিত স্বাধীন এই বাংলাদেশে নানা হত্যাযজ্ঞ। চলতে থাকে সেনাবাহিনীর মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা।
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর জেলখানায় নিহত হন জাতীয় চার নেতা। এর আগের দিন অর্থাৎ ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ  সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ  মোশাররফ ও ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তাকে করা হয় গৃহবন্দী।
এটা সত্য যে, ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে পাল্টে দিতে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। কয়েক দিনের জন্য চলতে থাকে সরকারবিহীন বাংলাদেশ। জনগণ নিমজ্জিত হয় চরম হতাশা ও আতঙ্কে। ফিরে আসছে একদলীয় শাসনের দুঃসময়। ফিরে আসছে রুশ-ভারত অক্ষশক্তির তাঁবেদারির যুগ। ফিরে আসছে সংবাদপত্রের শৃঙ্খলিত হওয়ার দিনগুলো। জনগণ ছিল কিংকর্তব্য বিমূঢ়।
তাদের পরম আস্থার উৎস সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানকারীদের দ্বারা বন্দি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে এই মানুষটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে হতবিহক্ষল জাতির প্রাণে প্রতিরোধের শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। সেই মানুষটিকে যারা বন্দি কিংবা হত্যা করতে পারে, তারা আর যাই হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বন্ধু হতে পারে না। এমনি এক শঙ্কা ও নৈরাশ্যের দুর্যোগে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর বিপ্লবী সৈনিকদের কামানের গোলার গর্জন কুচক্রীদের সব চক্রান্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কুচক্রীরা পালানোর পথ পায়নি।
সুবেহ সাদেকের সূর্যালোক উদ্ভাসিত হলে ঢাকায় রাজপথ। এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা। ট্রাকে ট্রাকে সৈনিকরা আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ করে তাদের বিজয়ের কথা জানান দিল। সৈনিক ও জনগণ অভূতপূর্ব আনন্দ মিছিলে যোগ দিল। সেনা ট্যাঙ্কে ফুলের মালা পরিয়ে জনগণ সিপাহী বিপ্লবকে অভিনন্দিত করল।  রেডিওতে আবার জিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমি জিয়া বলছি’। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ওপর  থেকে জগদ্দল পাথর সরে গেল।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে সংঘটিত হয় সিপাহী জনতার মহাবিপ্লব। বলা যায় এই বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে অটুট রেখেছিল। জাতিকে ইস্পাত কঠিন দিপ্ত শপথ নিতে আগামীর বাংলাদেশ গঠনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিধাহীনচিত্তে বলতে হয়, স্বাধীনতা দিবস সহ যে ক’টি দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বের দাবি করে, এ দিবসটি সেগুলোর মধ্যে অনন্য মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত।
নানা মুনির নানা মত। অনেকে বলেন, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জিয়া সেদিন মুক্ত হয়েছিলেন। আসলে ইতিহাস তা বলে না।
সিপাহী জনতার বিপ্লবে রয়েছে দু’টি দিক। একটি হচ্ছে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী তৈরি করা এবং সেই লক্ষে বিপুল সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক, জুনিয়র অফিসার কর্তৃক বন্দি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব¡ভার প্রদান এবং তাঁর নেতৃত্বে  সেনাবাহিনীর চেইন অভ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা করা।
কর্নেল অব. তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার  সেনা বাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য একজন জনপ্রিয় নেতৃত্ব বা মুখের প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হলেও অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় কর্নেল তাহেরের পক্ষে সেই নেতৃত্ব  দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা, জেড ফোর্স এর কমান্ডার এবং দু’টি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে এবং অসংখ্য সম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ  সেনাবাহিনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও যোগ্য অফিসার হিসেবে সকলের মাঝে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এ ছাড়াও দেশবাসীর মাঝেও একই কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমানের দারুন পজিটিভ ইমেজ ছিল।
কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকে বিভ্রান্ত করে দলে টানতে জিয়াউর রহমানের নাম ব্যবহার করেন এবং তাদেরকে বলেন, জেনারেল জিয়া তাদের সাথে আছেন। যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। কর্নেল তাহের চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর পরক্ষণেই জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে তাকে দিয়ে  টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে দেশবাসীকে এই অভ্যুত্থানের পক্ষে নিয়ে আসা। মূলত জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে এই ভাষণ দিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অভ্যুত্থানকে টেকসই করে এবং তাকে দিয়ে তাদের ১২ দফা দাবি পূরণ করে জেনারেল জিয়াকে সরিয়ে দেয়া। জেনারেল জিয়া কোনভাবেই কর্নেল তাহেরের এই কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ইতিহাসবোদ্দারা তাই বলেন।
৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে বলতে হয়, বিএনপি সৃষ্টি হয়েছিল জাতির এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। তেমনি শহিদ জিয়ার আগমন ঘটেছিল জাতির মহা এক ক্রান্তিকালে। আজকের এই দিনের ইতিহাস বলা যায় বিস্মৃতির পথে। যাদের ইতিহাস চর্চা করার কথা ছিল তারা আজ নিলিপ্ত। অথচ ৭ নভেম্বরের ইতিহাস থেকে আমরা কোন শিক্ষা গ্রহণ না করি এ জাতির রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বিপন্ন যে হবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? 
লেখক : আইনজীবী, কলামিষ্ট, সম্পাদক আজাদবার্তা।