খুলনা | শনিবার | ০৮ নভেম্বর ২০২৫ | ২৪ কার্তিক ১৪৩২

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ গোষ্ঠীচাপে আরেকটি দৃষ্টান্ত

|
১২:০৬ এ.এম | ০৮ নভেম্বর ২০২৫


সারা বিশ্বেই প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাবিদ ও শিশু অধিকারকর্মীরা প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা যুক্ত করার কথা বলে আসছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। গত ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। এটি নিশ্চিত করেই যৌক্তিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই ধর্মভিত্তিক কিছু গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন পরিসরে এ নিয়ে চাপ ও হুমকি তৈরি করে।
দুই মাসের মধ্যে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা’ পরিবর্তন করে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাদ দেওয়া গোষ্ঠীবিশেষের চাপের কাছে সরকারের নতি স্বীকারের আরেকটি মন্দ দৃষ্টান্ত। চাপের মুখে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সরকারের একটি ভুল পদক্ষেপ বলেই আমরা মনে করি। এর আগেও আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে সরকারকে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার কমিটি বাতিল করতে দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব গোষ্ঠীর চাপে সরকারকে বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ থেকে বারবার পিছু হটতে হচ্ছে, সরকার কি ধরে নিচ্ছে এই অংশ পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে?
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, সচিব কমিটির মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে এত অল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনবে না এবং এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। সরকারের যে ভাষ্য, তাতে মনে হচ্ছে অর্থের সংকটের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যাখ্যা কতটা যৌক্তিক হলো? সচিব কমিটি কেন আগে থেকে তাদের মূল্যায়ন জানায়নি?
সরকারের যে আর্থিক সামর্থ্য এবং শিক্ষায় যে বাজেট বরাদ্দ, তাতে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলাদা করে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া অসম্ভব কল্পনা। সেক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে কয়েকটি বিদ্যালয় নিয়ে ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের যে সিদ্ধান্ত এসেছিল, সেটা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে এখানে ধীরে ধীরে নিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু সরকারের এই উল্টোযাত্রায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সারা বিশ্বই মুখস্তনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের বিকাশের জন্য নানা সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করছে। সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা সহপাঠের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায়। কিন্তু আমরা শিক্ষার নামে শিশুদের ওপর গাইড, কোচিং আর ভারী বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি। আমাদের শিক্ষা যে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা তো দূরে থাক, দেশের কর্মসংস্থান বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সৃজনশীলতা উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা সবাই বললেও শিক্ষাকে ঘিরে যে বিশাল বাণিজ্য, তাতে যেসব গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত, যেকোনো সংস্কার উদ্যোগের বিরোধিতা তারা করে। বাংলাদেশের শিক্ষা তাই কর্মসংস্থানহীনতার সমার্থক হয়ে উঠেছে। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার সহজ পথ নেই, কিন্তু সূচনা করার একটা সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এসেছিল। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে গোষ্ঠীচাপে শিক্ষায় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার।
ধর্মীয় ও সামাজিক সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাকে ঐচ্ছিক করাটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু হুমকি ও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসাটা সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমরা আশা করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করবে।