খুলনা | রবিবার | ১৬ নভেম্বর ২০২৫ | ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

১০ দিনে গ্রেফতার ১৯৫

চার দিনে ২০ যানবাহনে আগুন, ৫০টিরও বেশি ককটেল বিস্ফোরণ

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৮ এ.এম | ১৪ নভেম্বর ২০২৫


রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের ঝটিকা মিছিলের ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর থেকেই রাজধানী জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা অস্থিরতা, জনমনে বাড়তে থাকে অস্থিরতা।
এমন পরিস্থিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে। এর মধ্যেই গত চার দিনে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ২০টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং ৫০টিরও বেশি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে গত ১০ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৯৫ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গত কয়েক দিন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা থাকলেও ১৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) দিনব্যাপী নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা ছিল রাজধানী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীতে বাড়ানো হয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ডিএমপি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। ফলে কোনও ধরণের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
অন্যদিকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়’ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় আগামী ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, রাজধানীতে নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ ও ঝটিকা মিছিলের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৩ নভেম্বর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৯৫ জন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা ১৩ নভেম্বর ঘিরে রাজধানীতে নাশকতা সৃষ্টি পরিকল্পনা ও ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গ জড়িত।
১২ নভেম্বরের অভিযানে ডিবি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৪৩ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও মহিলা লীগের সভাপতি।
ডিবি বলছে, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের ব্যানারে নাশকতা ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছিল।
এর একদিন আগে, ১১ নভেম্বর ৪৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, যারা ঝটিকা মিছিল, ককটেল বিস্ফোরণ এবং অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১০ নভেম্বর গ্রেফতার হয় আরও ২২ জন, যাদের কাছ থেকে পুলিশের হাতে আসে ভয়েস রেকর্ড, চ্যাট হিস্ট্রি ও মোবাইল যোগাযোগের প্রমাণ।
৯ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে ঝটিকা মিছিল ও নাশকতা পরিকল্পনায় জড়িত ৩৪ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি। এদের বিরুদ্ধে একাধিক থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
৩ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় বরগুনা, পল্টন, রমনা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলার ৭ জন নেতা-কর্মীকে, যারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন পদে ছিলেন। ৪ নভেম্বর গ্রেফতার হোন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমাসহ আরও ৭ জন।
৫ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকার ৪ নেতা-কর্মীকে, যাদের বিরুদ্ধে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে মামলা হয়। ৬ নভেম্বর আরও ৬ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি, যাদের মধ্যে রয়েছেন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা। ৭ নভেম্বর গ্রেফতার হন বরিশালের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, হবিগঞ্জ শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পল­বীর সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম খোকন।
৮ নভেম্বর রাজধানী জুড়ে অভিযান চালিয়ে ডিবি আরও ২৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে, যারা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা সংলগ্ন এলাকায় এক লাখ গ্যাস বেলুন উড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল।
সব মিলিয়ে গত ১০ দিনে ডিবি মোট ১৯৫ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে, যাদের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা, নাশকতা ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে।
ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগে আতঙ্ক : গত এক সপ্তাহে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং অর্ধশতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর আশুলিয়া, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বুধবার ভোরে আশুলিয়ায় আলীফ পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগের পর তা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। একই দিন গাজীপুরের বাসন ও কাশিমপুর থানার তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। মঙ্গলবার রাতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আলম এশিয়া পরিবহনের বাসে আগুন দিলে এক হেলপার ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান।
এর আগে সোমবার সকালে বাড্ডা ও নতুনবাজার এলাকায় দু’টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত অন্তত চারটি স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়েছে ঢাকায়। মঙ্গলবার রাতে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে দু’টি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এছাড়া শাহবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট ও মালিবাগে গত পাঁচ দিনে অন্তত ৫০টি বিস্ফোরণ ঘটে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘১ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর ১৫টি স্থানে ২৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এগুলো খুব নিম্নমানের, দেশীয় ভাবে তৈরি পটকার মতো বিস্ফোরক। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে আমরা সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর। রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এসব অভিযান চলছে।’
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সা¤প্রতিক সময়ের ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও প্রকাশ্য সহিংসতা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করছে বলে দুর্বৃত্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এই রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে না বের হলে সহিংসতা থামবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি অবনতির দিকে যায়, তাহলে তা নির্বাচনের পরিবেশকেও প্রভাবিত করবে। জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০১৩ সালের নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার মতো পরিস্থিতি আবারও দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সহিংসতার পথ পরিহার করে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে আসা।
ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিততে পুলিশ কাজ করছে। ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীতে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীবাসীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিততে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ 
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।