খুলনা | সোমবার | ১৭ নভেম্বর ২০২৫ | ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

পাউবোর কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ, ১৭২ দখলদারকে নোটিশ, উচ্ছেদে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই

বাগেরহাটের চিতলমারীতে পাউবো’র জমি দখলের মহোৎসব : জেলা জুড়ে দুই হাজার অবৈধ স্থাপনা

এস এস সোহান, বাগেরহাট |
০১:১৬ এ.এম | ১৭ নভেম্বর ২০২৫


সড়কের দুই পাশে সারি সারি ভবন, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কাঠের তৈরি বসত ঘর। রয়েছে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্র কুরমনি মৌজার এ চিত্র দেখে মনে হতে পারে সমৃদ্ধ কোন বসতি। বিষয়টি আসলে তা নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৩৬/১ পোল্ডারের দুই পাশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে পাউবোর জমি দখল করে এসব ইমারত নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন সময় এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে তালিকা ও চিঠি চালাচালি হলেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকারি এই দপ্তরটি। সবশেষ ২৭ অক্টোবর ১৭২টি অবৈধ স্থাপনার মালিককে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে পাউবো। দখলদার ও স্থানীয়দের ধারণা এবারও চিঠি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সরকারি এ জমি দখলমুক্ত হবে না অজানা কোন কারণে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চিতলমারী উপজেলা সদর বাজার সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেড়িবাঁধের দুই পাশে প্রভাবশালীদের ইমারত। এখানে রয়েছে চিতলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল খানের তিন তলা বাড়ি। তার বিপরীত পাশে মাস্টার দিন মোহাম্মাদের দুই তলা বাড়ি ও মার্কেট, যে ভবনে রয়েছে উপজেলা বিএনপি’র কার্যালয়ের সাইনবোর্ড, শহীদ জিয়া স্মৃতি সংঘের সাইনবোর্ড, কিছুদূর এগোলেই ইসলামী আন্দোলন নেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্সির তিনতলা ভবন, জেলা বিএনপি নেতা মঞ্জুর মোরশেদ স্বপনের একতলা ভবন, ডাঃ কাজী মফিদুল ইসলাম বাবুলের দুই তলা ভবন এ রকম অসংখ্য পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা ভবন রয়েছে এই সড়কের দুই পাশে।
সড়ক দিয়ে হাঁটার সময় দেখা হয় অসতিপর বৃদ্ধ আব্দুল গফফারের সাথে। বাঁধের দুই পাশের স্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন এখানে ভেড়িবাঁধ হয়েছে অনেক আগে। সড়কের দুই পাশে ফাঁকা জায়গা ছিল। পানিও ছিল, সব বালু ভরাট করে এই ভবন করেছে। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই এই ভবন নির্মাণ করেছে বলে দাবি তার।
তবে এ বিষয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা মুখ খোলেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, এসব ভবন ও ইমারত পানি উন্নয়ন বোর্ডের অজানা নয়। একটা তিন তলা ভবন করতে কমপক্ষে এক বছর লাগে, যখন নির্মাণ করেছে তখন কেন বাধা দেয়নি। এই চিঠি দিয়েছে, আবার দেখবেন দখলদাররা বহাল তবিয়তে আছে। আসলে টাকার কাছে সবাই দুর্বল। 
এদিকে বড় দখলদারদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল হোসেন খান কারাগারে রয়েছেন। আরও কয়েকজনকে ফোন করলে এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে ইসলামী আন্দোলন নেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্সি বলেন, যে জমিতে তার ভবন রয়েছে ওই জমি তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। উপজেলা পরিষদ থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিয়ে তিনি এই ভবন করেছেন। অনুমোদনের তালিকায় আরও অনেকের নাম রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাঁধের দুই পাশে থাকা হতদরিদ্ররা বলছেন নিজেদের জমি না থাকায় বসতি গড়েছেন। উচ্ছেদ হলে কোথায় যাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দখলদার বলেন, দেখেন সরকারি জায়গায় সরকারি লোকের সম্মতি ছাড়া আমরা ভবন করি নাই। কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ভবন করেছি। তার অভিযোগের তীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজস্ব সার্ভেয়ার মোঃ নাইমুল হকের দিকে। 
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নাইমুল হক বলেন, অল্পদিন হয়েছে তিনি এই দায়িত্ব পেয়েছেন। দখলদারদের চিঠি দেওয়ায় তারা এই প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন।
এর আগে পাউবো, বাগেরহাটের সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন সমীর বিশ্বাস। দখলদারদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ও চাকুরি দেওয়ার কথা বলে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয় পাউবো। 
চিতলমারী উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি মুমিনুল হক টুলু বিশ্বাস বলেন, তার দলের কেউ এই দখল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নয়। আর দখলদার যতই শক্তিশালি হোক তাকে উচ্ছেদ করে সরকারি জমি সাধারণ মানুষের কল্যানে কাজে ব্যবহারের অনুরোধ করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌশলী এড. এস. এম মাহাবুব মোর্শেদ লালন বলেন, শুধু চিতলমারী নয়, জেলার সর্বত্রই সরকারি জমি, রাস্তা ও হাটঘাটে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছে একটি অসাধু চক্র। যার ফলে সরকার রাজস্ব থেকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সরকারি জমিও বেহাত হচ্ছে। প্রচলিত আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
পাউবো বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল­াহ আল মামুন বলেন নতুন করে কেউ যাতে অবৈধ দখল করতে না পারে সেজন্য কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। আর নোটিশ জারির পরে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। সেব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই শুরু হবে উচ্ছেদ অভিযান।
দখল প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এই দপ্তরের কোন কর্মচারী-কর্মকর্তা যদি এমন কোন কাজে যুক্ত হয় তার প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী বাগেরহাটের ৯টি উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত ৩ হাজার ৬শ’ একর জমি রয়েছে, এসব জমিতে ২ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।