খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২০ নভেম্বর ২০২৫ | ৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

শেখ হাসিনার সাজা : প্রমাণিত হলো, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন

|
১২:২৩ এ.এম | ২০ নভেম্বর ২০২৫


চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম একটি মামলার রায় হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত সোমবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন। অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং এই মামলার রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল­াহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আদালত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ দেন। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে ‘শহিদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারগুলোর জন্য স্বস্তির এবং ন্যায়বিচারের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে বিচারবহির্ভূত ও নির্বিচার হত্যা, হামলা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেফতারের মতো অপরাধ ব্যাপক মাত্রায় সংঘটিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নির্বিচার প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন। হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। এতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। তাঁদের বেশির ভাগই প্রাণ হারান রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। আহত হন ২০ হাজারের বেশি মানুষ, যাঁদের অনেকে চিরতরে অন্ধ হয়েছেন ও অঙ্গ হারিয়েছেন।
গত ফেব্র“য়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, জুলাই-আগস্টে আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাকাঠামো আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান, আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ, আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ ও আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ। এর মধ্যে ১ নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা) প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় অভিযোগসহ মোট তিনটি অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এই রায় নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছেন বা ভবিষ্যতে যাবেন, তাঁদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায় বিচারপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায়ই চূড়ান্ত নয়। বাদী-বিবাদীপক্ষের উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে। আপিল বিভাগে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। এ মামলার দুই আসামিই পলাতক ও ভারতে অবস্থান করছেন। রায় ঘোষণার পর অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে হস্তান্তরের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায়কে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ডাকা কর্মসূচি ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাসে আগুন, চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ, ব্যাংকে আগুন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেট্রোলবোমা, গাছ কেটে সড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই সজাগ ও কঠোর হতে হবে।
ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ও দলীয় নেতা-কর্মীদের আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূত বলপ্রয়োগের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে যে চরম অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটাই এই মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্র রচনা করেছিল।
এই রায় নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছেন বা ভবিষ্যতে যাবেন, তাঁদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।