খুলনা | শনিবার | ২২ নভেম্বর ২০২৫ | ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

আহতদের লম্বা সারি পঙ্গু হাসপাতালে কারও ভেঙেছে হাত-পা, কারও মেরুদন্ডের হাড়

খবর প্রতিবেদন |
০১:২০ এ.এম | ২২ নভেম্বর ২০২৫


রাজধানীর আশুলিয়ার তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকেন বিউটি বেগম (৩৫) ও তার পরিবার। সকালে কাপড় শুকানোর জন্য একাই গিয়েছিলেন ভবনের ছাদে। রশিতে কাপড় মেলে দেয়ার সময় হঠাৎ করেই দুলতে থাকে ভবন আর ছাদ। আশেপাশেরও ভবন গাছ-পালা যেন সবই দুলছে। রশিতে টানানো কাপড় রশির একদিক থেকে আরেক দিকে যাচ্ছে, আবার কোনোটা পড়ে গিয়েছে নিচে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথা ঘুরে তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে যান বিউটি বেগম। প্রাণে বেঁচে গেলেও এই গৃহিণী মাথা, কোমর ও পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে তাকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে এসেছেন স্বজনরা। শুধু তিনি এই হাসপাতালে একা আসেননি, সকাল থেকে ভূমিকম্পে আহতদের অনেকেই আসেন এখানে। 
আহত ৯০ জনকে চিকিৎসা, ১০ জনের অপারেশন : হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে ও ভারী বস্তু চাপা পড়ে আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের চিকিৎসায় লম্বা সারি পড়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতালে)। বিকেল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত রাজধানী ও আশেপাশের জেলা থেকে এই হাসপাতালে ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে ভবন থেকে নামতে গিয়ে আহত ৯০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট-বড় অপারেশন করা হয়েছে ১০ জনের। 
বিউটি বেগমের মা হানুফা বেগম বলেন, ‘সকালে ভূমিকম্পের সময় বিউটি বেগম ছাদে কাপড় শুকাতে যায়। সেখানে কম্পনের সময় ছাদ থেকে নিচতলায় পড়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে সাভারের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মাথা, ঘাড়, কোমর ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন। ডাক্তার কয়েকটি টেস্ট দিয়েছে, সেগুলো করলে বোঝা যাবে কোথায় কোথায় ভেঙে গেছে। তবে কোমরে অনেক ব্যথা, মেয়ের কোমরটা ভেঙে গেল কিনা। বিছানায় মেয়ে পড়ে গেছে দুইটি সন্তানের কি হবে।’
রিকশা থেকে পড়ে পঙ্গু হাসপাতালে : টঙ্গীর কামাড়পাড়ায় প্রতিদিনের মতো রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন আব্দুল মোতালেব। সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর ঢাকায় ভূমিকম্পের সময় রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। পরের পাঁচ মিনিট সেখানে কোনো লোকের দেখা পাননি তিনি। পরে স্থানীয়রা এসে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখান থেকে মোতালেবকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। 
আব্দুল মোতালেবের ছেলে অন্তর ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বাবা ভূমিকম্পে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে সেখানে পাঁচ মিনিট ছিল। তখন পর্যন্ত কারও দেখা পাননি। পরে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিলে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়। ডান পা ভেঙে গেছে। ডাক্তার বলেছেন অপারেশন করতে হবে।’
তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আহত : মহাখালীর ৭ম তলা ভবনের ৫ম তলায় দুই রুমের ফ্লাটে থাকেন মনজ মধু ও তার স্ত্রী রাশি সেন। সকালের ভূমিকম্পে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে রাশি সেন পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পান। দুপুরের দিকে একবার স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে আসলে সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাসায় পাঠানো হয়। কিন্তু এতেও ব্যথা না কমলে মনজ আবার স্ত্রীকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন।
আতঙ্কে নামতে গিয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে : কাওলার ৭ম তলা ভবনে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন আবিদ আল হাসান। শুক্রবার ছুটির দিনে ভূমিকম্পের সময় তারা সকালের নাস্তা করছিলেন। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি ভবন কাঁপতে থাকে। আসবাবপত্র, দেয়ালিকা, দেয়ালঘড়ি পড়ে যায়। কিছু বোঝার আগেই দরজা খুলে স্বামী-স্ত্রী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য দৌড় দেন। সিঁড়িতে পা বেঁকে গিয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্ত্রী মিথিলা হাসানের পা ভেঙে যায়। বিকালে স্ত্রীকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন আবিল আল হাসান। 
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই ভবন কেঁপে উঠে। দেয়াল ঘড়িটি পড়ে যায়। মনে হচ্ছিল চেয়ার থেকে পড়ে যাব। তখন নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য দ্রুত সিঁড়ির দিকে যাই। সেখানে স্ত্রী মিথিলা পড়ে যায়।’
কালাচাঁদপুর থেকে আসা ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে কোমরের হাড়ে গুরুতর আঘাত পান। আব্দুল্লাপুরের ইয়াসিন আরাফাত জানান, অফিসে কাজ করার সময় ভূমিকম্পে আলমারি তার ওপর পড়ে ডান হাত ভেঙে গেছে। নতুন বাজার বেড়াইতের তানজিমা ফেরদৌস (৪০) মাথা ঘুরে পড়ে কোমরে আঘাত পান। মিরপুর-৬ এর মনিম সিঁড়ি থেকে পড়ে বাম পা ভেঙে ফেলেছেন।
সিদ্ধিরগঞ্জের মুড়ি বিক্রেতা আবদুস সোবহান জানান, চায়ের দোকানে ছিলাম, মাথা ঘুরে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে-বাম পা-টা ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বসুন্ধরা, রামপুরা, হাতিরঝিল, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু আহত পঙ্গু হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন।
সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবুল কেনান বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশির ভাগেরই হাত-পা ভাঙাসহ বিভিন্ন ধরনের আঘাত রয়েছে। এ পর্যন্ত ৯০ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহত হওয়ায় ১৮ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ডাঃ কেনান বলেন, ‘আহতদের অধিকাংশই ঢাকার আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা। যাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে হালকা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পের পর সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ড মাস্টারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।