খুলনা | মঙ্গলবার | ২৫ নভেম্বর ২০২৫ | ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

ভূমিকম্পের ঝুঁকি, চাই কার্যকর প্রস্তুতি

|
১২:১৬ এ.এম | ২৪ নভেম্বর ২০২৫


দেশের বিভিন্ন স্থানে শুক্র ও শনিবার কয়েক দফা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্প আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাকে আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ১০ জন মানুষের মৃত্যু এবং ছয় শতাধিক মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপার নয়; এর চেয়েও বড় সমস্যা। এটা আমাদের নগর-পরিকল্পনা, অবকাঠামো, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও জনসচেতনতার ভয়াবহ ঘাটতি। শুক্রবারের ভূমিকম্পে যে হতাহত হয়েছে, তা মূলত রেলিং ও দেয়াল ধসে, ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া ও আতঙ্কে ছোটাছুটি করার কারণেই। অর্থাৎ কম্পনের তীব্রতার চেয়ে প্রস্তুতির অভাবই মানুষের প্রাণ কেড়েছে বেশি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত মানবসৃষ্ট ভুলের ফল। 
গবেষকেরা বলছেন, নরসিংদী ও আশপাশের অঞ্চলটি সাবডাকশন জোনবার্মা প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। এই অঞ্চলে শত শত বছর ধরে শক্তি জমছে, যে শক্তি প্রায় ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। শুক্রবারের ভূমিকম্প সেই শক্তির সামান্য অংশমাত্র। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন-সামনে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে এবং আমাদের প্রস্তুতি একেবারেই অপ্রতুল। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা শহর। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অনিয়ন্ত্রিত নগরীগুলোর একটি ঢাকা; যেখানে ৯৫ শতাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান যুগের ভবন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার নতুন অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে ভূমিকম্প-সহনশীলতার কোনো মানদণ্ডই বাস্তবে নিশ্চিত করা হয়নি। সরকারি ভবনও এর ব্যতিক্রম নয়। ভূমিকম্প প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ানোকে এখনো ‘অতিরিক্ত খরচের বিষয়’ ভাবা হয়। তবে খরচ বাঁচাতে গিয়ে যে মানুষের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, কোথায় অবস্থান করতে হবে, কোন জায়গা নিরাপদ-এসবই বেশির ভাগ মানুষের অজানা। স্কুল, কলেজ, অফিস, বাজার-সব জায়গায় নিয়মিত মহড়া চালু করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যে ‘ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটিও যুগোপযোগী করতে হবে। উদ্ধারকাজে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে কোনো লাভ নেই। এর বদলে অল্প বাজেটে নিয়মিত মহড়া, প্রশিক্ষণ, স্কুলভিত্তিক শিক্ষা এবং স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন অনেক বেশি কার্যকর হবে। জাপান, চিলি বা নেপালের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায়-প্রস্তুতি থাকলে প্রাণহানি অনেক কমে যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নগর-পরিকল্পনার সংস্কার করতে হবে। বর্তমান নগরায়ণকে ৫০-১০০ বছরের মধ্যে বদলানো কঠিন। কিন্তু যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো দ্রুত তালিকাভুক্ত করে ভাঙা বা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন সব নির্মাণে কঠোরভাবে বিল্ডিং কোড মানা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার, সিটি করপোরেশন, রাজউকসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
পরপর দুই দিনের ভূমিকম্প আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে-সময় খুব বেশি নেই। আগামী ভূমিকম্প আরও তীব্র ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আমরা চাই না আবার কোনো রাফিউল, শিশু ফাতেমা বা কোনো পরিবারের স্বপ্ন এভাবে ধসে পড়–ক। এখনই বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নিয়মিত অনুশীলন ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে ভূমিকম্পে ঝুঁকি কমানোর কাজ শুরু করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না, কিন্তু প্রস্তুত থাকলে জীবন বাঁচানো সম্ভব-সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা অনুধাবন করতে হবে।