খুলনা | মঙ্গলবার | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

উৎসব ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মোংলা সমুদ্র বন্দরের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ও মোংলা প্রতিনিধি |
০২:১৮ এ.এম | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫


আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্বোধন, বন্দর ব্যবহারকারী ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান, বিদায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংবর্ধনা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুভেচ্ছা উপহার, ডকুমেন্টারি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মোংলা বন্দরের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (প্লাটিনাম জয়ন্তী) উদযাপন করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিথিরা না থাকায় শুধু মাত্র বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সংবাদকর্মীদের নিয়ে বন্দর প্রতিষ্ঠা দিবসের আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে বেলা সাড়ে ১১টায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্যোগে শোভা যাত্রা বের হয় বন্দর এলাকায়। এর আগে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে প্রতিষ্ঠা বাষির্কীর শুভ উদ্বোধন করেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল শাহীন রহমানসহ বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ উপলক্ষে সোমবার মোংলা বন্দরের স্টাফিং-আনস্টাফিং শেডে আলোচনা সভা ও সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহীন রহমান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বলেন, মোংলা বন্দর হলো সেবা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বন্দরের সক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বর্তমানে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর বিদেশি জাহাজ, কার্গো হ্যান্ডলিং ও গাড়ি আমদানিতে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর থেকে জেটি পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার নৌপথের নাব্যতা ধরে রাখা জরুরি। সকলের প্রচেষ্টায় আজকের এই বন্দর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র এ বন্দরের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ঐতিহ্য ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করার আহবান জানান।  
বন্দর সূত্র জানায়, ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের দ্বিতীয় মোংলা সমুদ্র বন্দরের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পিডি-৪(৪৮)/৫০/১ সংখ্যক গেজেট নোটিফিকেশন বলে ১ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে চালনা পোর্ট নামে এ বন্দর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৮৭ সালের পোর্ট অব চালনা অথরিটি এ্যাক্ট অনুসারে প্রথমে চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পরবর্তীতে মোংলা পোর্ট অথরিটি নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। 
৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও তারুণ্যের উৎসব পালন উপলক্ষে উচ্ছ¡াসপূর্ণ লগ্ন বিবেচনায় রাত ১২টা ১ মিনিটে বন্দরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি সকল জাহাজে এক মিনিট বিরতিহীন হুইসেল বাজানো হয়। 
বন্দরের জেটির অভ্যন্তরে ৭৫ তম বন্দর প্লাটিনাম জয়ন্তী দিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বন্দর। এ সময় বন্দরের সম্মানিত সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর মোঃ শফিকুল ইসলাম সরকার, সদস্য (অর্থ) ও পরিচালক (প্রশাসন) (অঃ দাঃ) কাজী আবেদ হোসেন (যুগ্ম-সচিব), সদস্য (প্রকৌশল ও উন্নয়ন) ড. এ কে এম আনিসুর রহমান (যুগ্ম-সচিব), পরিচালক (বোর্ড) কালাচাঁদ সিংহ (যুগ্ম-সচিব), ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, হারবার মাস্টার, কর্নেল মোঃ ফিরোজ ওয়াহিদসহ বিভাগীয় প্রধানগণ, বন্দরের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বন্দর ব্যবহারকারীগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। 
মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী হিসেবে সর্বোচ্চ জাহাজ কয়লা, মাসুল প্রদান, সার, সাধারণ পণ্য, গ্যাস, কন্টেইনারবাহী জাহাজ আনায়নকারী, গাড়ির জাহাজ, মালামাল হ্যান্ডলিংসহ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শাহীন রহমান। এছাড়া বন্দরের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বন্দরে ১৩ জন কর্মকরতা-কর্মচারীকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। গত বছরের ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালে এ পর্যন্ত পিআরএল ভোগরত ৫৬ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিদায় সংবর্ধনা প্রদান করেন বন্দর চেয়ারম্যান। 
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল শাহীন রহমান জানান, বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কার্গো হ্যান্ডলিং-এর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৮ লক্ষ ৮০ হাজার মেট্রিক টন, অর্থবছর শেষে বন্দরে ১ কোটি ৪ লক্ষ ১২ হাজার মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং এর মধ্য দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ লক্ষ ৩২ হাজার মেট্রিক টন এবং ১৭.২৫% (শতাংশ) বেশি কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে এ মোংলা বন্দর দিয়ে।
এছাড়াও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার টিইইউজ, অর্থবছর শেষে বন্দরে ২১ হাজার ৪৫৬ টিইইউজ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর মধ্য দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৫৬ টিইইউজ এবং ৭.২৮% (শতাংশ) বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৩৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা, অর্থবছর শেষে বন্দরে ৩৪৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা এবং ২.৮৩% (শতাংশ) বেশি রাজস্ব আয় করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের নীট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২০ কোটি ৪৬ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, সেখানে ৬২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা নীট মুনাফা অর্জন করা হয়েছে। যার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪১ কোটি ৬৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, যা ২০৩.৪৯% বেশি মুনাফা অর্জন করা হয়েছে।
বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ফলে প্রতি ঘন্টায় ২৪টিরও বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হচ্ছে এবং জেটির সম্মুখে নিয়মিত ড্রেজিং এর ফলে নাব্যতা বিরাজমান থাকায় ৫টি জোটতে একই সাথে ৫টি বাণিজ্যিক জাহাজ হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হচ্ছে।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসে জাহাজ এসেছে ৩৫৬ টি, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩,৮৫৪ টিইউজ, গাড়ি আমদানি ৪,১৩৯ টি, পন্য আমদানি-রপ্তানি ৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশে ট্রানজিট পণ্য মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির সুদূর প্রসারী সুসম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মোংলা বন্দর ব্যবহার করে স্থল, নৌ এবং রেলপথের মাধ্যমে রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের পণ্য পরিবহনকে সহজতর এবং দ্রুত করবে। 
তিনি আরো বলেন, মোংলা বন্দরে ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে Port Reception Faciliti (PRF) প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে যা উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। এর ফলে এ অঞ্চলে তেলবাহী কোনো জাহাজ বা ট্যাংকার হতে দুর্ঘটনা বশতঃ পানিতে তেল নিঃসরণ হলে তেল অপসারণকারী ভেসেলের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে নদী ও সামুদ্রিক পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষা করার সক্ষমতা অর্জন করবে মোংলা বন্দর। 
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ এ বন্দরটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বর্তমানে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, সার, মোটর গাড়ি, মেশিনারিজ, চাল, গম, কয়লা, তেল, পাথর, ভুট্টা, তেলবীজ, এলপিজি গ্যাস আমদানি এবং সাদামাছ, চিংড়ি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত খাদ্য, কাকড়া, ক্লে, টাইলস, রেশমী কাপড় ও জেনারেল কার্গো রপ্তানির মাধ্যমে দেশের চলমান অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে সম্ভাবনাময় এ মোংলা সমুদ্র বন্দরটি। আমরা চাই, বিশ্বমানের নিরাপদ ও আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনা। বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বমানের বন্দরে রূপায়ন করা, চ্যানেলে নাব্যতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ, কার্গো ও কন্টেইনার সংরক্ষণের সুবিধাদি বৃদ্ধি এবং আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এ বন্দরকে আন্তর্জাতিক ও ব্যাবসায়ী বন্দরে রুপান্তি করাই মূল লক্ষ্য।