খুলনা | রবিবার | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

নারীদের অনলাইন নির্যাতন: বাস্তব জগতের মতোই বিপজ্জনক এক নীরব সহিংসতা

জয়া মাহবুব |
১১:২৮ পি.এম | ১২ ডিসেম্বর ২০২৫


ইন্টারনেটকে আমরা অনেকেই স্বাধীনতার জায়গা মনে করি। কিন্তু এই স্বাধীনতার আড়ালে এমন এক নীরব সহিংসতা বাড়ছে, যা বিশেষ করে নারীদের জীবনে গভীর ক্ষতের মতো থেকে যাচ্ছে। অনলাইন নির্যাতন আমাদের সমাজের পুরোনো প্যাটার্নগুলোকেই ডিজিটাল পর্দায় তুলে আনে, কিন্তু আরও দ্রæত, আরও তীব্র, আর অনেক সময় আরও নির্মমভাবে।
আজকের বাংলাদেশে একটি মেয়ের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট, ইনস্টাগ্রামের ইনবক্স, টিকটকের কমেন্ট সেকশন কোথাও সে পুরোপুরি নিরাপদ নয়। অযাচিত বার্তা, অশালীন মন্তব্য, চেহারা নিয়ে কটাক্ষ, চরিত্র নিয়ে সন্দেহ-এসব যেন প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ আবার ‘ডক্সিং’-এর মতো গুরুতর অপরাধের শিকার হন, যেখানে ব্যক্তিগত ছবি, ফোন নম্বর বা ঠিকানা প্রকাশ করে তাকে সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। এর পাশাপাশি, ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে মুখ বিকৃত করে বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অশালীন ছবি তৈরি করে দ্রæত ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা ভুক্তভোগীর জীবনকে মুহূর্তের মধ্যে নরকে পরিণত করে। এগুলো শুধু “অনলাইনে যা-তা বলা” এত সরল নয়। এগুলো প্রকৃত সহিংসতা, যার প্রভাব বাস্তব জীবনে গভীরভাবে অনুভূত হয়।
অনেক মেয়েই বলেন, তারা আগে যেসব ছবি শেয়ার করতেন, এখন আর তেমনভাবে পোস্ট করেন না। কেউ বলেন, কমেন্ট পড়তে ভয় লাগে। কেউ বলেন, বøক করে লাভ নেই, একটা ছদ্মনামি এ্যাকাউন্ট গেলে আরও পাঁচটা এসে দাঁড়ায়। যেকোনো সময় যেকোনো মানুষ একটা অপমানজনক বার্তা লিখে দিতে পারে, এই অনিশ্চয়তা একটা অদৃশ্য মানসিক চাপ তৈরি করে। ধীরে ধীরে গলা চেপে ধরে আত্মবিশ্বাসকে। এ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সা¤প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে দেশে ৬৩.৫১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হেনস্তা শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা তৈরি করে, উদ্বেগ ও বিষন্নতা বাড়ায় এবং ভুক্তভোগীদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের পতন ঘটায় যা অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কেউ নিজের ছবি দিতে সাহস পান না, কেউ ব্যবসার পেজ চালাতে সংকোচ বোধ করেন, কেউ আবার মতামত প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন। পেশাদার নারী বা তরুণ শিক্ষার্থীরা হয়রানির ভয়ে অনলাইন ক্লাস বা মিটিংয়ে ক্যামেরা বন্ধ রাখেন বা নিজেদের মতামত দিতে ভয় পান। এই পরিস্থিতি নারীদের কণ্ঠকে চুপ করিয়ে দেয়। এটাই আসলে অনলাইন সহিংসতার সবচেয়ে বড় বিপদ। এই নীরবতার কারণে শুধু ব্যক্তির ক্ষতি হয় না; দেশের অর্থনৈতিক উদ্ভাবন এবং সমাজের সামগ্রিক সৃজনশীলতাও মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়। একটি সমাজ তখনই দুর্বল হয়, যখন তার অর্ধেক জনগোষ্ঠী ভয় আর অপমানের কারণে নীরব থাকতে বাধ্য হয়।
ডিজিটাল হুমকির আরেকটি দিক হলো সাইবার বুলিং ও চরিত্রহনন। অনেক সময় সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কর্মস্থলে ঈর্ষা, বা একতরফা প্রতিশোধের কারণেও নারীরা অনলাইনে টার্গেট হন। কারও ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে ছড়িয়ে দেওয়া, মিথ্যা তথ্য তৈরি করে ভাইরাল করা, কিংবা তাকে ‘বদনাম’ করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা-এসবই এখন খুব সহজ, কারণ আমাদের সমাজ “মেয়েটাই হয়তো কিছু করেছে!” এই ধারণা বিশ্বাস করতে প্রস্তুত থাকে। তবে সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য আমাদের ভার্চুয়াল ভিক্টিম বেøমিং সম্পর্কে জানতে হবে, অনলাইন নির্যাতন কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটা মনস্তাত্তি¡ক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যা।
ভার্চুয়াল ভিক্টিম বেøমিং হলো সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে দোষারোপ করার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। এই আচরণটি আক্রমণকারীকে উৎসাহিত করে এবং ভুক্তভোগীকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যখন কোনো নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হন, তখন সমাজের একটি অংশ প্রায়শই মন্তব্য করে, “কেন তুমি এমন ছবি দিয়েছিলে?”, “তোমার ওই ধরনের মন্তব্য করাই উচিত হয়নি,” বা “তুমি নিজেই তোমার প্রাইভেসি সেটিংস দুর্বল রেখেছিলে।” এই দোষারোপের মাধ্যমে পুরো ঘটনাটিকে তুচ্ছ করা হয় এবং বলা হয়, “অনলাইন তো এমন হবে, তোমার এতটা স্পর্শকাতর হওয়া উচিত নয়।” এই মানসিকতা মূলত আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি, যা নারীর স্বাধীনতা ও অনলাইন উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না, তাই কোনো সমস্যা হলেই দ্রæত নারীকে দোষী সাব্যস্ত করে। এই ‘ভার্চুয়াল ব্লেমিং’ মানসিকতা ভুক্তভোগীকে দ্বিগুণ মানসিক আঘাত দেয় এবং আক্রমণকারীকে আরও উৎসাহিত করে। অনলাইন নির্যাতনকে “তুচ্ছ” ভাবার সময় শেষ। এটি বাস্তব জীবনের সহিংসতার মতোই ক্ষতিকর, কখনো কখনো আরও বেশি। যদিও আইনে ব্যবস্থা আছে, তবে মামলার দীর্ঘসূত্রতা, প্রমাণ সংগ্রহের অসুবিধা এবং সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে ভুক্তভোগীরা আইনি সহায়তা নিতে প্রায়শই পিছপা হন। 
এই সমস্যার সমাধানে আমাদের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে যেমন সাইবার অপরাধ দমন আইনের কার্যকর ব্যবহার, প্ল্যাটফর্মের কঠোর মনিটরিং এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি, তেমনই অন্যদিকে পরিবার ও সমাজে মনস্তাত্তি¡ক পরিবর্তন আনা আবশ্যক। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলোর স্থানীয় আইন ও সংস্কৃতি অনুযায়ী দ্রæত ও কার্যকর মডারেশন নীতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখা প্রয়োজন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ডিজিটাল নৈতিকতা এবং ইন্টারনেটের দায়িত্বশীল ব্যবহার শেখানো এবং এই বিষয়ে স্কুল পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। পরিবারে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা দরকার, যেখানে মেয়েদের সবসময় “চুপ থাক” শেখানোর বদলে, তাদের পাশে দাঁড়ানো হবে। বিশেষত, ভার্চুয়াল ব্লেমিং-এর বিপদ সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করা এবং এই ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করা জরুরি। পুরুষ বা অন্য নারীরা যখন অনলাইনে কোনো নারীর প্রতি সহিংসতা দেখেন, তখন তাদের নীরব দর্শক না হয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলা বা রিপোর্ট করার মাধ্যমে সম্মিলিত সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই সাথে, নারীদেরকে তাদের এ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি সেটিংস জোরদার করা এবং হয়রানি হলে তাৎক্ষণিক স্ক্রিনশট নিয়ে আইনি সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন। নারীরা যখন অনলাইনে নিরাপদ হবে, তখনই তারা সত্যিকার অর্থে তাদের কণ্ঠস্বর, সৃজনশীলতা এবং স্বাধীনতা নিয়ে সামনে আসতে পারবে। সমাজের অংশ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব-এটা নিশ্চিত করা যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারীদের জন্য নতুন রাস্তা খুলে দেবে, নতুন ভয় নয়।