খুলনা | রবিবার | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৬ পৌষ ১৪৩২

জানাজায় লাখো জনতা, কেঁদেছে পুরো দেশ

খবর প্রতিবেদন |
০১:২৬ এ.এম | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫


ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদীর নামাজের জানাজা ছিল অভূতপূর্ব এমনটাই বলছেন উপস্থিত মুসল্লীরা। জনসমুদ্রের মতো ভিড়, শোকস্তব্ধ পরিবেশ আর এক হৃদয়স্পর্শী নীরবতা মিলিয়ে এই জানাজা যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায় হয়ে উঠেছে। অনেকেই বলছেন, “জীবনে এত বড় জানাজা আর কখনো দেখিনি।” জানাজায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই বলছেন, শহীদ ওসমান হাদির জানাজায় ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। 
শনিবার দুপুর দুইটা ২৫ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেকেই সংসদ ভবনের মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ের রাস্তায় চোখে অশ্র“ নিয়ে দাঁড়িয়ে হাদির জানাজায় অংশ নেন। জানাজার পর তার লাশ এ্যাম্বুলেন্সযোগে সমাধিস্থলে নিয়ে আসা হয়।
জানাজায় তো বটেই হাদির দাফনের সময়ও মানুষ কেঁদেছেন। তাকে এক পলক দেখার জন্য কেঁদেছেন, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। অনেকেই চোখের জল আড়াল করতে গিয়েও পারেননি। হাদির জানাজার সময় মানিক মিয়া এভিউনিউ যেন ছিল এদিন এক খন্ড বাংলাদেশের চিত্র।
জানাজা শুরু হওয়ার অনেক আগেই আশপাশের সড়ক, মাঠ ও খোলা জায়গা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন শেষ বিদায় জানাতে। বয়স্ক, তরুণ, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে দাঁড়িয়ে, অনেকে বসে, আবার অনেকে রাস্তার ওপর সারিবদ্ধ হয়ে জানাজায় শরিক হন।
৬৫ বছর বয়সী ধানমন্ডির বাসিন্দা ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমার জীবনে অনেক জানাজায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু এত বড় জানাজা দেখিনি। শহীদ হাদি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এ কারণে এত মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন।
মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, আমার ৪২ বছরের জীবনে এত বড় জানাজা দেখিনি। আমার ধারণা ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আকিব হাসান বলেন, হাদি ভাইয়ের জানাজায় কত লাখ মানুষ হয়েছে বলতে পারবো না। তবে এত মানুষ জীবনেও দেখিনি।
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সালাউদ্দিন বলেন, আমার ধারণা জানাজায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ হয়েছে।
মুসল্লিদের মতে, এই বিশাল উপস্থিতি শুধু একটি জানাজা নয়, এটি ছিল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের এক সম্মিলিত প্রকাশ। কারও চোখে অশ্র“, কারও কণ্ঠে দোয়া, সমবেত মানুষের হৃদয়ে একই অনুভূতি, একই প্রার্থনা।
স্থানীয়রা জানান, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবকরা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেও জানাজা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। শেষ দোয়ায় গোটা প্রাঙ্গণ যেন একসাথে নিঃশ্বাস ধরে রাখে।
এই জানাজা নিয়ে মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা, এটি শুধু সংখ্যার দিক থেকে বড় ছিল না, ছিল আবেগ, সম্মান আর স্মৃতির দিক থেকেও ঐতিহাসিক। অনেকের বিশ্বাস, এমন দৃশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘদিন মনে গেঁথে থাকবে।
কান্নায় ভেঙে পড়েন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক (এনসিপি) নাহিদ ইসলাম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ সংগঠক সারজিস আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতকর্মীদের কাঁদতে দেখা গেছে। কেঁদেছেন ব্যারিস্টার ফুয়াদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শুধু তাই নয়, হাদির মৃত্যুর পর থেকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরেও কান্নার রোল পড়ে যায়। বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে মায়েরা রাস্তায় নামেন, কান্না করতে করতে হাদি হত্যার বিচার চান। ঘরে বসে থাকতে পারেননি বৃদ্ধরাও। কেউ কেউ তাদের সন্তানদের কাঁধে নিয়ে হাদি হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় নামেন। সবার মুখে একই কথা, আমাদের হাদি চাই। এক হাদি চলে গেছে, লাখো হাদির জন্ম হবে।
সামাজিক মাধ্যমেও হাদির জন্য ছড়িয়ে পড়েছে শোকগাঁথা। হাদিকে হারিয়ে কাঁদছে দেশের সবশ্রেণির মানুষ। এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার সন্তানকে কাঁধে করতে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় হাটছেন। চিৎকার করে বলছেন, আমার হাদি চাই, এই বাংলাদেশ হাদিকে চায়। আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমার বাংলাদেশের জন্য হাদিকে প্রয়োজন। 
আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ নারী কোনো এক সংবাদ সম্মেলনে হাদিকে নিয়ে কথা বলার সময় কান্না করছেন। তিনিও হাদি হত্যার বিচার চাইছেন।
হাদিকে যারা চেহারায় চেনেন না, না শুনেছেন। জেনেছেন হাদি গণঅভ্যুত্থানের অগ্র সেনানী, ভারতীয় আগ্রসনবিরোধী; তারাও কেঁদেছেন। যে শাহবার একটা সময় ফ্যাসিস্টদের আস্তাবল ছিল, সেখানেও মানুষের কান্নার রোল পড়েছে। 
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর আড়াইটায় শহীদ ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার বড় ভাই জানাজায় ইমামতি করেন। দুপুর ১টার মধ্যে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার দু’টি বড় মাঠ মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপর মানুষের উপস্থিতিতে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর বিশাল রাজপথ ছাপিয়ে ফার্মগেটের খামারবাড়ি, আসাদগেট পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ওইদিন চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্তও ছিল মানুষ আর মানুষ।
জানাজার আগে শহীদ ওসমান হাদির ভাই যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন লাখ লাখ মানুষ ছিলেন অশ্র“সিক্ত।
জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য সকাল থেকেই মানুষ মিছিল সহকারে, কেউবা নিজ উদ্যোগে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর দিকে আসতে শুরু করেন। রাজধানীর সব পথ যেন এসে মিলে এক মোহনায়।