খুলনা | সোমবার | ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৭ পৌষ ১৪৩২

বাংলাদেশি হাইকমিশনারকে ‘হুমকি’ : ‘দিল্লি ও আগরতলায় ভিসা সেবা সাময়িক বন্ধ’

দিল্লিতে হামলার বিষয়ে ভারতের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান ঢাকার

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৯ এ.এম | ২২ ডিসেম্বর ২০২৫


দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে উগ্র ভারতীয়দের হামলার ঘটনায় দিল্লির ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে অন্তর্র্বতী সরকার। একইসঙ্গে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার কথাও বলছে সরকার। রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ প্রতিক্রিয়া জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ভারতীয় প্রেস নোটে যা বলা হয়েছে এটা সম্পূর্ণভাবে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করি এজন্য যে, বিষয়টি যত সহজভাবে উত্থাপন করা হয়েছে অত সহজ না। আমাদের মিশন, বাংলাদেশের মিশন কূটনৈতিক এলাকার ভেতরে, এমন না যে এটা বাইরে কোনো জায়গায় বা কূটনৈতিক এলাকার শুরুতে, তা কিন্তু না। তারা বলছে, ২০-২৫ জনের একটি দল, হতে পারে; আবার সংখ্যা বেশিও হতে পারে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ২৫ জনের একটি হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের লোকজন এতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেন? একটা সুরক্ষিত এলাকা, তার মানে তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে। যেভাবে হোক তারা আসতে পেরেছে, আসার কথা না কিন্তু। তারা সেখানে হিন্দু নাগরিক হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে চলে গেছে, তা না কিন্তু। তারা অনেক কিছু বলেছে, সেটা আমরা জানি।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমার কাছে প্রমাণ নাই যে হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও শুনেছি যে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমার কথা হলো এ পর্যন্ত আসতে পারবে কেন এবং এসে হুমকি দিতে পারবে কেন। এটা আমরা গ্রহণ করি না।
তিনি বলেন, এখানে ব্যাপারটা এরকম না যে তারা এসেছে, দু’টো স্লোগান দিয়েছে। এর ভেতরে কিন্তু একটা পরিবার বাস করে। হাইকমিশনার এবং তার পরিবার সেখানে বাস করে। তারা কিন্তু হুমকি অনুভব করেছে এবং আতঙ্কিত হয়েছে। কারণ, অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, মাত্র দু’জন নিরাপত্তা কর্মী ছিল, তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজেই এটাকে আরেকটু প্রচেষ্টা করাটা সত্যিকার অর্থে ওই দেশের দায়িত্ব।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা মনে করি, সাধারণ নিয়মে নিরাপত্তার বিষয়ে যে নিয়মকানুন আছে সেটা এখানে পালিত হয়নি। তারা বলছে, আমাদের সব মিশনের নিরাপত্তা দেখছে, আমরা সেটা নোট করেছি।
হাইকমিশনে হামলা নিয়ে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য এসেছে বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, আমাদের গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন এসেছে সেটাকে তারা বলছে ভুলভাবে উপস্থাপন, এটাও সত্য না। আমাদের পত্রপত্রিকায় মোটামুটি সঠিক রিপোর্টই এসেছে।
ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, একজন বাংলাদেশি নাগরিক নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এটার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি একসঙ্গে করে ফেলার কোনো মানে হয় না। যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং অবিলম্বে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শুধু যে বাংলাদেশে ঘটে তা না, এ অঞ্চলের সব দেশে ঘটে এবং প্রত্যেক দেশের দায়িত্ব হচ্ছে সেক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। বাংলাদেশ সেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা কোন ফরম্যাটে প্রতিবাদ করবে বিশেষ করে, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতকে তলব করা হবে কি না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ফরম্যাট নিয়ে আমরা আলাপ না করাই ভালো। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, আমরাও রাখি; যোগাযোগ কিন্তু আছে। আমরা যেটা বলার বলি। আমরা কী করব আমাদের ওপর ছেড়ে দেন। আমরা তো ব্যবস্থা নিচ্ছি, সেটা দেখতে পাচ্ছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথাবার্তা হচ্ছে। আমি যে কথাটা বলছি সেটা তো বাংলাদেশ সরকারের কথা।
ঢাকা ও দিল্লির টানাপড়নে বাংলাদেশ দেশটিতে মিশন ছোট করে আনার বিষয়ে ভাবছে কি না-জানতে চাইলে তিনি জানান, যদি তেমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাহলে আমরা সেটা করব। এখন পর্যন্ত যেটা দেখছি, আমরা এখনো ভরসা রাখছি ভারত যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হুমকি : ভারতের দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের গেটে এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার মো. ফয়সাল মাহমুদ জানান, ‘শনিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ৯টা নাগাদ তিনটি গাড়িতে করে কিছু লোক এসে বাংলাদেশ ভবনের গেটে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করে। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কিছু কথাবার্তা বলছে-হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে; হাইকমিশনারকে ধরো। পরে তারা মেইন গেটের সামনে এসে কিছুক্ষণ চিৎকার করে। ওরা চিৎকার করে চলে গেছে-এতটুকুই আমি জানি।’
হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে কিনা-জানতে চাইলে প্রেস মিনিস্টার বলেন, ‘হতে পারে। কথাগুলো হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে বলেছে। ওখানে হিন্দু মেরে ফেললে আমরা তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলব, এ রকম কথাবার্তা বলেছে।’
জানা গেছে, উগ্র ভারতীয়রা হাইকমিশনের বাংলাদেশ ভবন থেকে যাওয়ার পর রাতে হাইকমিশনার জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডিফেন্স উইংয়ের সঙ্গে বসেন এবং এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ডিফেন্স উইংয়ের এক কর্মকর্তা হাইকমিশনারকে জানান, ওরা এসে চিৎকার করে চলে গেছে, বাড়তি কিছু করেনি।
হুমকি প্রসঙ্গে ভারতের বক্তব্য : নয়া দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রাঙ্গণে শনিবার (২০ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে বিক্ষোভ করে একদল উগ্র হিন্দু। সেখানে তারা সব নিরাপত্তা বেষ্টনি অতিক্রম করে বাংলাদেশ হাউসের মূল ফটকের সামনে উপস্থিত হয়। বাংলাদেশ বিরোধী নানা স্লোগান দেয় এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হত্যার হুমকি দেয়। এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটি দাবি করছে, বাংলাদেশি হাইকমিশনের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, ঘটনাটি নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
রণধীর জয়সওয়াল জানান, শনিবার (২০ ডিসেম্বর) প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন তরুণ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়ে ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে স্লোগান দেন এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবি তোলেন। তবে কোনো সময়ই হাইকমিশনের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভাঙার চেষ্টা বা নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
ভারতের সরকারি মুখপাত্র বলেন, ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সংক্রান্ত দৃশ্যমান প্রমাণ জনসমক্ষে উপলব্ধ রয়েছে।
রণধীর জয়সওয়াল জানান, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী ভারতের ভূখন্ডে অবস্থিত সব বিদেশি মিশন ও কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত প্রতিশ্র“তিবদ্ধ।
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর ভারত নিবিড়ভাবে নজর রাখছে উল্লেখ করে জয়সওয়াল বলেন, ভারতীয় কর্মকর্তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারতের গভীর উদ্বেগ তাদের জানানো হয়েছে। পাশাপাশি দীপু চন্দ্র দাস হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহŸানও জানানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি কয়েকটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে নীতিনির্ধারক সূত্র জানিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে দিল্লি ও আগরতলায় ভিসা সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার বিষয়টিও রয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। ২০০৪ সালের শেষ দিকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হলে সে সময়ও উগ্রবাদী হিন্দু গোষ্ঠী বাংলাদেশ হাইকমিশনের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগোতে চেষ্টা করেছিল। তবে তখন পুলিশ হাইকমিশন থেকে কিছুটা দূরেই তাদের প্রতিহত করে। এছাড়া গত বছরের অক্টোবরে আগরতলায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে হামলা চালিয়ে উগ্রবাদীরা ব্যাপক ভাঙচুর করে।