খুলনা | বুধবার | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৯ পৌষ ১৪৩২

দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষা, ঢাকামুখী জনস্রোত, বরণে চলছে মহাযজ্ঞ

অপেক্ষার প্রহর শেষ, তারেক রহমানকে বরণ করতে প্রস্তুত নতুন বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিনিধি |
০১:০৫ এ.এম | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫


একদিন-দু’দিন নয়, দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার প্রহর অবশেষে ফুরোচ্ছে দেশের মানুষের। আর মাত্র একদিন পরই দেশের মাটি ছুঁয়ে দেখবেন গণমানুষের নেতা, আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
প্রিয় নেতার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে এবং তাকে বরণ করতে বিএনপিতে চলছে মহা কর্মযজ্ঞ। ‘লিডার আসছে’ ব্যানার নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ঢাকামুখী জনস্রোত।
রাজধানীর খিলক্ষেত-বসুন্ধরার ৩০০ ফিটে তারেক রহমানকে দেওয়া হবে গণসংবর্ধনা। প্রস্তুত হয়েছে সংবর্ধনা সমাবেশের বিশাল দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কৃতজ্ঞতা জানাবেন দেশবাসীর প্রতি।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) লন্ডন থেকে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখবেন তারেক রহমান। তার দেশে ফেরার তারিখ ঘোষণার পর থেকেই সারাদেশে বিরাজ করছে এক ভিন্ন আবহ উজ্জীবিত দলীয় নেতাকর্মী, জনগণের অপেক্ষা আর প্রত্যাশায় ভরা রাজনৈতিক অঙ্গন।
লন্ডন ত্যাগ : দেশটির স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ১২টায়) হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তারেক রহমান।
তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-২০২ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১১টায় তাকে বহনকারী উড়োজাহাজ সিলেটে অবতরণ করবে। এরপর দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতর করবেন তিনি। তারেক রহমানের সঙ্গে দেশের মাটিতে ফিরবেন তার সহধর্মিণী ডাঃ জুবাইদা রহমান ও একমাত্র মেয়ে জাইমা রহমান। এছাড়া ব্যক্তিগত স্টাফও তার সঙ্গে আসার কথা রয়েছে।
সমাবেশ সফল করতে গঠিত শৃঙ্খলা কমিটি কাজ করছে। সাজানো হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক টিম। সমাবেশে এলাকা ও মঞ্চের আশপাশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। তাদের পাশাপাশি কাজ করছেন বিএনপি’র চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা টিমের (সিএসএফ) সদস্যরা।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে স্মরণকালের বৃহত্তম গণজমায়েতের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি’র।
দলীয় কর্মসূচি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থলে আসবেন তারেক রহমান। এখান থেকে সরাসরি যাবেন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ মা বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে। সেখানে মায়ের শয্যাপাশে কিছু সময় কাটিয়ে গুলশানে মায়ের বাসায় উঠবেন ।
২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন ৬০ বছর বয়সী তারেক রহমান। ২০০৯ সালে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ২০১৮ সালে তার মা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তখন থেকেই তিনি বিদেশ থেকে দল পরিচালনা করছেন, ভার্চুয়ালি সভা ও সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। লন্ডন থেকে বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি গণমানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে। ১৮ মাস কারাগারে থাকার সময় অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তারেক রহমান। এক সপ্তাহ পরে, ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে পরিবারের সদস্যদেরকে সাথে নিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন তিনি।
প্রবাসে থাকা অবস্থাতেই ২০১৫ সালে ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। তার জানাজায়ও শরিক হওয়ার সুযোগ পাননি। মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন দীর্ঘদিন।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেশের এবং দলের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি’র নেতাদের মতে, তারেক রহমানের দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক বার্তা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে আলাদা করে তুলেছে। তার আগমন ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে তারেক রহমানের থাকার জন্য রাজধানীর গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়ি প্রস্তুত করা হচ্ছে। যদি কোনো কারণে বাড়ি পুরোপুরি প্রস্তুত না হয় তাহলে তিনি পাশের মায়ের থাকার বাড়ি ফিরোজায় উঠবেন। ফিরোজায় দুই-তিনটি রুম আগেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিনই রাজধানীর ৩০০ ফিটে সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন। এই সমাবেশে জনসমাগম নির্বিঘœ করতে বিএনপি ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১০টি রুটে স্পেশাল ট্রেন ও অতিরিক্ত বগি সংযোজন করবে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক কৌতূহল ও আলোচনা। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের অফিস ও নেতাকর্মী, এমনকি ঘরোয়া পরিবেশেও আলোচনায় তারেক রহমান।
দলের শীর্ষ নেতাকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী। নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। নগরীর প্রধান সড়ক, অলি-গলি ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ঝুলছে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও বিলবোর্ড। এতে বড় অক্ষরে উৎকীর্ণ-‘লিডার আসছে’, ‘হে বিজয়ী বীর, তোমাকে স্বাগত’ ইত্যাদি স্লোগান।
বিএনপি’র নেতাকর্মীরা বলছেন, কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়, সিলেট থেকে কুড়িগ্রাম দেশের প্রান্তিক জনপদগুলো থেকেও ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামবে। ছাত্র, যুবক, শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে আগ্রহী। সব মিলে ২৫ ডিসেম্বর দলের নেতাকর্মীদের কাছে এক আবেগঘন অধ্যায়, ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
প্রস্তুত গুলশান ১৯৬ : ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আগমনকে কেন্দ্র করে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে বিএনপি’র গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়। প্রস্তুত গুলশান-২ এর এভিনিউ রোডের ১৯৬ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতে উঠবেন তিনি। গুলশান কার্যালয় এবং তার থাকার বাড়ির চারপাশে কাঁটাতার দিয়ে করা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে প্রজেক্টর। যার মাধ্যমে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য লাইভ দেখানো হবে।
দল ও নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি : নেতাকর্মীদের আসার সুবিধার্থে বিএনপি’র পক্ষ থেকে ২৪ ডিসেম্বর রাতের বিভিন্ন রুটে ট্রেন রিজার্ভ করা হয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ভাড়া পরিশোধ করা হবে। দলের পক্ষ থেকে কক্সবাজার-ঢাকা, সিলেট-ঢাকা, জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা,টাঙ্গাইল-ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকা, পঞ্চগড়-নিলফামারী-পার্বতীপুর-ঢাকা ও কুড়িগ্রাম-রংপুর-ঢাকা রুটের জন্য একটি করে স্পেশাল ট্রেন বা অতিরিক্ত বগি রিজার্ভ করা হয়েছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৩০০ ফিটে গণসংবর্ধনার মঞ্চ নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন। একতলা ভবনের সমান উঁচু, ৪৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩৬ ফুট প্রস্থের বিশাল মঞ্চ। প্রতিদিনই দলের সিনিয়র নেতারা গণসংবর্ধনার স্থান প্রত্যক্ষভাবে তদারকি করছেন। ৩০০ ফিট জুড়ে সহস্রাধিক মাইক লাগানো কাজ চলছে।
নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকবেন তারেক রহমান। বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিট হয়ে এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং গুলশান এভিনিউয়ের বাসভবন পর্যন্ত পুরো পথটি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হবে। এতে এসএসএফ, পুলিশ, র‌্যাবসহ বিএনপি’র চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স সিএসএফ তারেক রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।
বিদেশ থেকে আমদানি করা বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন একটি বুলেটপ্র“ফ ‘হার্ড জিপ’ গাড়ি তারেক রহমানকে বহন করবে। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো এলসি ২৫০ মডেলের গাড়িটি ইতিমধ্যে বিএনপি’র নামে নিবন্ধিত হয়েছে। এ ছাড়া তার নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য একটি বুলেটপ্র“ফ বাসও দেশে এসেছে।
এদিকে, বিমান, ট্রেন ও সড়কপথে নেতাকর্মীদের ঢাকামুখী স্রোত শুরু হয়েছে। তারা রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল এবং আত্মীয়দের বাড়িতে উঠছেন। ৩০০ ফিট, গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানাতে গত ১ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই হচ্ছে স্থায়ী কমিটির বৈঠক। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ নেতাদের সাথে নিয়মিত সভা করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে নগরবাসী যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে এবং ঢাকা বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের তদারকির বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।
কয়েকজন জেলা নেতা জানান, ২৪ ডিসেম্বর তাদের ঢাকায় আসার কথা থাকলেও গাড়িস্বল্পতার কারণে হাজার হাজার নেতাকর্মীর এক দিনে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর দুই দিন ধরে পর্যায়ক্রমে ঢাকায় আসবেন।
লন্ডন থেকে বিদায় : দীর্ঘ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। তবে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ভিড় না করতে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন।
গত ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনের সিটি প্যাভিলিয়নে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তারেক রহমান বলেন, লন্ডনের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ, ২৫ তারিখ আপনাদের দোয়ায়, আল­াহর রহমতে আমি দেশে ফিরে যাব। দয়া করে কেউ সেদিন আপনারা এয়ারপোর্টে যাবেন না।
তারেক রহমান বলেন, আমার আজকের এই অনুরোধ যারা রাখবেন ধরে নেব, তারা দল ও সর্বোপরি দেশের সম্মানের প্রতি মর্যাদা রাখবেন। এয়ারপোর্টে না যাওয়ার অনুরোধের পরও যারা যাবেন ধরে নেব, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য গেছেন।
সকলের কাছে দোয়া চেয়ে তারেক রহমান বলেন, আপনাদের সামনে যে পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেছি, আল­াহ যেন তৌফিক দেন দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য সেই কাজগুলো যেন সম্পন্ন করতে পারি।