খুলনা | শুক্রবার | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১২ পৌষ ১৪৩২

অশুদ্ধ নিয়ত আমলকে ধ্বংস করে

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
১২:০৮ এ.এম | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫


যে কোন আমল কবুলের পূর্ব শর্ত হলো পরিশুদ্ধ নিয়ত। কারণ, আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষের চেহারা, সুরত, বংশ, পদ-মর্যাদা ইত্যাদি দেখে বিচার করবেন না। তিনি শুধু দেখতে চান পবিত্র অন্তর। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদের শরীর ও চেহারার দিকে তাকান না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও কর্ম (মুসলিম)। আমল যতো ভালোই হোক না কেন, আর যত বেশীই হোক না কেন, এটা যদি খালেছ আল্লাহ’র জন্য না হয় তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালা এটা গ্রহণ করবেন না। কারণ আল্লাহপাক যে কোন শরীক থেকে মুক্ত। এইজন্য তিনি এটা পছন্দ করেন না যে তার সাথে কাউকে শরিক করা হোক। কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে একজন ঘোষণাকারী উচ্চস্বরে এই ঘোষণা দিবেঃ যে ব্যক্তি কোন আমলের মধ্যে অন্য কাউকে শরীক করেছে সে যেন তার কাছ থেকে আমলের ছওয়াব বা বদলা চেয়ে নেয়। আল্লাহ তায়ালা অংশীদারীর ব্যাপারে সকল শরীকদের চাইতে অধিক বে-নিয়াজ ও অমুখাপেক্ষী। আমরা যে উদ্দেশ্যে যে আমল তার বদলাও ঠিক তেমন পাবো। আমীরুল মুুমিনীন হযরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর (সঃ) এরশাদ করেনঃ প্রত্যেক কাজের প্রতিদান তার নিয়তের ওপর নির্ভর করে। প্রত্যেকেই যে নিয়তে কাজ করবে সে তাই পাবে। কাজেই যে হিজরত করেছে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য তার হিজরত আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্যই হবে। আর যে হিজরত করেছে দুনিয়া পাবার জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার জন্য, তার হিজরত ওই জন্যই হবে (বুখারী, মুসলিম)। আবু মুসা আশয়ারী (রা.) বলেন, মহানবীকে (সঃ) জিজ্ঞাসা করা হলোঃ কোন ব্যক্তি বীরত্ব দেখানোর জন্য লড়াই করে, আর কেউ আত্মসম্মান ও বংশ মর্যাদার জন্য যুদ্ধ করে, আবার কেউ বা লোক দেখানোর জন্য যুদ্ধ করে- এদের মধ্যে কে আল্লাহ’র জন্য যুদ্ধ করলো? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ’র কলেমা বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করলো সেই আল্লাহ’র পথে (বুখারী, মুসলিম)। 
বিশুদ্ধ নিয়ত যেমন পূণ্যের কারণ, ঠিক তেমনি বদ নিয়ত হলো বরবাদী বা ধ্বংসের কারণ। আমলের ভিতরে এখলাছ না থাকার কারণে কিয়ামতের দিন বড় বড় আমলও কোন কাজে আসবে না। শুধুমাত্র যে আমলের মধ্যে নিয়ত থাকবে মহান আল্লাহ’র রেজামন্দি তাই কেবল কবুল করা হবে, আর বাকি সব আমল ছুঁড়ে ফেলা হবে। এ ব্যাপারটি সহীহ হাদিসে পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে সমস্ত লোকের বিচারের রায় শুনানো হবে তাদের মধ্যে একজন ওই শহীদ হবে যাকে ডেকে আল্লাহ তায়ালা ওই সমস্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করাবেন যা তাকে দুনিয়াতে দেওয়া হয়েছিল। নেয়ামত সমূহ দেখে সে চিনতে পারবে এবং সমস্ত নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এই সমস্ত নেয়ামত পেয়ে তুমি দুনিয়াতে কি আমল করেছিলে? সে উত্তর দিবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ করেছি, এমনকি শহীদ হয়ে গিয়েছি। এরশাদ হবে, তুমি মিথ্যা বলছো; বরং লোকেরা তোমাকে বীর পুরুষ বলবে এইজন্য জিহাদ করেছিলে। সুতরাং তা তো দুনিয়াতেই তোমাকে বলা হয়েছে এবং যে উদ্দেশ্যে জিহাদ করেছিলে তা তোমার হাসিল হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে হুকুম শুনিয়ে দেবা হবে এবং অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর একজন আলেমের বিচার হবে যে নিজে এলেম শিখেছে, অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কোরআনপাক হাসিল করেছে। আগের মতোই তাকে ডেকে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর প্রদত্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করাবেন। সেও সমস্ত নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এই সমস্ত নেয়ামত পেয়ে তুমি দুনিয়াতে কি আমল করেছিলে? সে উত্তর দিবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি নিজে এলেম শিখেছি, অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি এবং কোরআনপাক হাসিল করেছি। এরশাদ হবে, তুমি মিথ্যা বলছো; বরং লোকেরা তোমাকে আলেম বলবে এইজন্য এলেম শিখেছো এবং লোকেরা তোমাকে ক্বারী বলবে এইজন্য কোরআন পড়েছো। সুতরাং তা তো দুনিয়াতেই বলা হয়েছে, অর্থাৎ শিখা ও শিখানোর সে উদ্দেশ্যে তোমার দুনিয়াতেই হাসিল হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে হুকুম শুনিয়ে দেয়া হবে এবং অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর একজন ধনী ব্যক্তির বিচার হবে যাকে আল্লাহপাক রিজিকের প্রস্থতা দান করেছিলেন এবং সবরকম ধন-সম্পদ দিয়েছিলেন। তাকে ডাকা হবে এবং নেয়ামত সমূহের কথা স্মরণ করানো হবে এবং স্বীকারোক্তির পর জিজ্ঞাসা করা হবে, এই সমস্ত ধন-সম্পদ পেয়ে তুমি দুনিয়াতে কি আমল করেছিলে? সে উত্তর দিবে, এমন কোন উত্তম জায়গা নেই যেখানে দান করলে তোমার সন্তুষ্টি লাভ হয় আর আমি খরচ করেনি। আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এরশাদ হবে, তুমি মিথ্যা বলছো; বরং লোকেরা তোমাকে দানশীল বলবে এইজন্য তুমি এসব করেছিলে। সুতরাং তা তো দুনিয়াতেই বলা হয়েছে। এরপর তাকেও হুকুম শুনিয়ে দেয়া হবে এবং অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (মুসলিম)। সুতরাং আমল ছোট হোক বা বড়, একমাত্র আল্লা’র সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে বড় বড় নেকীর আমলও বরবাদ হয়ে যায়। 
লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়; অস্ট্রেলিয়া থেকে।