খুলনা | শনিবার | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১২ পৌষ ১৪৩২

গ্রামাঞ্চলে এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাংস

সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে হরিণ শিকার বেড়েছে কয়েকগুণ, নেপথ্যে এলাকার প্রভাবশালীরা

মাহমুদ হাসান, মোংলা |
১১:৫০ পি.এম | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫


পুর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে বেড়েই চলেছে হরিন শিকারের প্রবণতা। শুধু চাঁদপাই নয় শরণখোলা রেঞ্জ এবং পশ্চিম সুন্দরবনে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত চক্রের তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশীর ভাগই এ অপকর্মের সাথে জড়িত বন তীরবর্তী এলাকার বসবাসকারীরা। তারা এলাকার প্রভাশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়মিত হরিণ মেরে মাংস ও তার চামড়া বিক্রি করছে। এ কাজের সাথে জড়িত রয়েছে মাছ ও কাকড়া আহরনের জেলেরা। অনেক সময় কাকড়া ও বড় বড় মাছ শিকার করতে টোপ বানাতেও এক শ্রেণীর জেলে ব্যবহার করছে হরিণের মাংস। সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের অভিযান অব্যাহত থাকলেও বন বিভাগ নিষ্ক্রিয়। মোংলাস্থ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সূত্রে জানা যায় বিভিন্ন সময় বিপুল পরিমান হরিনের মাংস উদ্ধার ও শিকারী আটক করা হলেও থেমে নেই তাদের অপতৎপরতা। 
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এবং বনবিভাগের কিছু অসৎ কর্মচারীর সহায়তায় শিকারিরা নিয়মিত হরিণ শিকার করছে। কোস্টগার্ড এবং বনরক্ষীদের হাতে দু’চারটি হরিণ পাচারের ঘটনা ধরা পরলেও শিকারিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে খুব সহজেই বেরিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। আবার গোপনে যে পরিমাণ হরিণ শিকার হচ্ছে তার অধিকাংশই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা জানান হরিণ শিকার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। গহীর বনে ফাঁদ পেতে হরিন মেরে মাংস বিক্রি করছে শিকারীরা। যারাই এ হরিণ শিকারের সাথে জড়িত তারা সকলেই স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে যোগাযোগ রেখেই এ অবৈধ কাজে নেমেছে। শিকারিদের বিরুদ্ধে কথা বললে হামলা-মামলার হুমকি দেওয়া হয় তাদেরকে। খোদ বনের মধ্যেই কাঁকড়া ও বড় মাছ শিকারিরাও ব্যাপক ভাবে হরিণ মেরে কাকড়ার খাবার তৈরি করে থাকে বলে জানান তারা।
পূর্ব সুন্দরবনের জয়মনির ঘোল, বৈদ্যমারী, জিউধারা, নন্দবালা, দাকোপের রেখোমারী, সুন্দরবন ইউনিয়ন সংলগ্ন এলাকা। এছাড়া শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, মোড়েলগঞ্জের জিউধরা,পাথরঘাটর চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া এলাকার শিকারিরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে জেলেবেশে  সুন্দরবনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করে লোকালয়ে নিয়ে আসে। অনেক চোরা শিকারি আবার গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ মেরে থাকে। রামপাল ও সাতক্ষীরা এলাকার কাকড়া জেলেরা কাঁকড়ার টোপ বানাতে নিয়মিত হরিণ শিকার করছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া হরিণ বেশী শিকার হয় সুন্দরবনের সুপতি, দুবলা, কটকা, কচিখালী,বাদামতলা, চান্দেশ্বর, টিয়ারচর, কোকিলমুনি, আন্ধারমানিক সহ গভীর বনের সুবিধাজনক স্থানে নাইলনের ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে থাকে। শিকারিরা মাছের পেটিতে বরফ দিয়ে সুবিধা জনক সময় লোকালয়ে পাচার করে থাকে। আর পাইকারী দরে প্রতি কেজি হরিনের মাংস বিক্রি করছে ৭শ’ টাকা। সেগুলো গ্রাম বা শহরের বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকায় বলে ক্রেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে।
হরিণ শিকার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁদ, বিষটোপ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হরিণ শিকার করা হয়। কোন কোন সময় শিকারী চক্র মাছ ধরার জেলেদের ছদ্মবেশে বনের গহিণে গিয়ে হরিণ শিকার করে তা গোপনে লোকালয়ে আনছে। পরে শিকার করা হরিণ কৌশলে লোকালয় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। এ জন্য সংঘবদ্ধ শিকারী চক্রের লোকালয়ে নির্দিষ্ট এজেন্ট নিয়োজিত রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন হাত বদল হয়ে পৌয়ে যায় তাদের নিজেস্ব গন্তব্যে। 
এব্যপারে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন হরিণ শিকার বন্ধে কোস্টগার্ডের কিছু অভিযান দৃশ্যমান হলেও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুন্দরবনে এই অপতৎপরতা বেড়েই চলেছে। বনবিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে উলে­খ করে তিনি আরো বলেন সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ধরা পড়া হরিণ শিকারিদের জন্য কঠোর আইনও করা জরুরি।
পুর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা রানা দেব বলেন, হরিণ শিকারিদের ধরতে বনবিভাগের নিয়মিত টহল অব্যাহত আছে। বন বিভাগের কেউ জড়িত থাকলে প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর শিকারিদের অপতৎপরতা ঠেকাতে যে আইন আছে, সেই আইন আরও কঠোর করতে সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সিয়াম উল হক বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বণ্যপ্রাণি শিকার ও পাচার রোধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।