খুলনা | মঙ্গলবার | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৫ পৌষ ১৪৩২

ফিরে দেখা ২০২৫ : বরেণ্য ও প্রাজ্ঞ আলেমে দীনের প্রস্থান

খবর প্রতিবেদন |
০১:৪৫ এ.এম | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫


ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে আরও একটি বছর ঝরে যাচ্ছে। জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ৩৬৫ দিনের একটি পূর্ণ অধ্যায়। নতুন বছরের আগমনে চারদিকে যখন আনন্দ আর নতুনের জয়গান, ঠিক তখনই বিদায়ি বছরের স্মৃতিগুলো মনের কোণে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে। ২০২৫ হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এক অম্লমধুর সংমিশ্রণ ছিল এই বছরটি। স্মৃতিপটে সবচেয়ে বড় বেদনার রং লেপে দিয়েছে দেশের বেশ কয়েকজন বরেণ্য ও প্রাজ্ঞ আলেমে দীনের প্রস্থান। জাতির এই আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকাদের বিদায় আমাদের জনজীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। ২০২৫ সালে আমাদের ছেড়ে যাওয়া সেই মহান আলেমদের কথা, যাদের জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য ছিল আলোকবর্তিকা:
আল্লামা সুলতান যওক নদভী : দেশের শীর্ষ আলেম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী নদভী ইন্তেকাল করেন ২ মে (শুক্রবার)।
আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লিগ অব ইসলামিক লিটারেচারের বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া তিনি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা বোর্ড আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৩৭ সালে মহেশখালীর জাগীরাঘোনা মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে সালে আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়াপাটিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, ১৪০৪ হিজরি সালে ভারতের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা থেকে সম্মানসূচক আলমিয়াত ডিগ্রি লাভ করেন।
আল্লামা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী : বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী ইন্তেকাল করেন ৪ এপ্রিল (শুক্রবার)। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী দেশের অন্যতম শীর্ষ বুজুর্গ আলেম মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)-এর ছোট ছেলে ছিলেন। তিনি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম ছিলেন। এছাড়াও তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহসভাপতি ছিলেন। দেশের শীর্ষ আলেমদের মধ্যে তিনি শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে গণ্য হতেন।
মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ : দেশের ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার শাইখুল হাদিস ও সদরুল মুহতামিম বরেণ্য আলেম মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন ১৪ সেপ্টেম্বর (রোববার)।
মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ ১৯৪১ সালের ১২ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার নাইখাইন গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মুহাম্মদ ইসা। তার নানা মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শাহ আহমদ হাসান (রহঃ) ছিলেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠিতা।
শৈশব কালেই নিজ পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। ৭ বছর বয়সে পিতার কাছে কোরআন শরীফের নাজেরা শেষ করেন। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ১০ বছর বয়সে কুরআন শরিফের হেফজ সমাপ্ত করে কিতাব বিভাগে অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে ২১ বছর বয়সে এখান থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন।
উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাকিস্তান গমন করে জামিয়া আশরাফিয়  লাহোরে ভর্তি হন। সেখানে দাওরায়ে হাদিসের কিতাবাদি আবারও অধ্যয়ন করেন। এখানে তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভি, মাওলানা রাসূল খান, মাওলানা ফয়েজ আলী শাহ, মাওলানা জামিল আহমদ থানভী, মাওলানা আবদুর রহমান আম্রছড়ি, মাওলানা উবায়দুল্লাহ আম্রছড়ি প্রমুখ।
১৯৬৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। দীর্ঘ ২৩ বছর অধ্যাপনা করার পর হাজি মুহাম্মদ ইউনুসের অনুরোধে তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ায় যোগদান করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন।
মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী : ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব ও জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী ইন্তেকাল করেন ১১ নভেম্বর (মঙ্গলবার)।
মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী দীর্ঘদিন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। সারাদেশে বিস্তৃত বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষাবোর্ডের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আলেম হিসেবে তিনি সারাদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস কাসেমী : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস কাসেমী ইন্তেকাল করেন ২৯ নভেম্বর (শনিবার)। মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস কাসেমী জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীর ছোট ভাই। তিনি রাজধানীর মানিকনগর মাদ্রাসা ছাড়াও একাধিক মাদ্রাসায় হাদিসের দরস দিতেন।
মাওলানা রফিকুর রহমান : খুলনা দারুল উলুম মাদ্রাসার সাবেক নায়েবে মুহতামিম এবং মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার সদরে মুহতামিম মাওলানা রফিকুর রহমান। ২ জানুয়ারি খুলনার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার তেলজুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুর বাহিরদিয়া মাদ্রাসা, গহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৬ ছেলে, ৩ মেয়ে ও অসংখ্য অনুরাগী রেখে গেছেন।
আল্লামা মুকাদ্দাস আলি : ৬৬ বছর ধরে বুখারি শরিফ পড়াতেন সিলেটের প্রবীণ আলেম ও শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলি। বুধবার ৮ জানুয়ারি সকালে ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৯১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন শায়খ মুকাদ্দাস আলি।  তিনি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মুনশিবাজার মাদ্রাসার শিক্ষক ও শাইখুল হাদিস ছিলেন। ১৯৩৩ সালে ভারত সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৯৬০ সালে শায়খ মুকাদ্দাস আলি নিজ জন্মভূমি জকিগঞ্জ উপজেলার মুনশিবাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনে পা দেন। যোগদানের পরের বছরই তাকে মাদ্রাসার শায়খুল হাদিসের মসনদে সমাসীন করা হয়। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে একই পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।
লালবাগ মাদ্রাসার মাওলানা আব্দুর রহিম : ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শূরা সদস্য মাওলানা আবদুর রহিম ইন্তেকাল করেন (২৮ ডিসেম্বর)।  মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে, অসংখ্য নাতি-নাতনী এবং বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আজ সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) জোহরের নামাজের পর তাঁর নিজ বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুজাফফরগঞ্জে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।
শায়খুল হাদিস মাওলানা মাহবুবুল হক : রাজধানীর লালমাটিয়া মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা মাহবুবুল হক ইন্তেকাল করেন ১৫ ডিসেম্বর। মাওলানা মাহবুবুল হক (রহঃ) দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে লালমাটিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগেও তিনি দেশের একাধিক প্রসিদ্ধ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি তিন ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। শিক্ষাজীবনে তিনি প্রাথমিকভাবে কাফিয়া পর্যন্ত গহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। এরপর শরহে বেকায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে জালালাইন থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন ভারতের ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম দেওবন্দে।
তাবলিগের মুরুব্বি মাওলানা মোশাররফ হোসেন : তাবলিগ জামাতের প্রবীণ মুরুব্বি মাওলানা মোশাররফ হোসেন ইন্তেকাল করেন ৩০ আগস্ট (শনিবার)। মাওলানা মোশাররফ হোসেন তাবলিগের শখছি নেজামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাবলিগের কাজে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনি শখছি নেজামের বিশ্ব ইজতেমায় জুমার নামাজের ইমামতি করতেন।
তরুণ আলেম লেখক রায়হান খাইরুল্লাহ : পবিত্র ওমরাহ পালন করতে গিয়ে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সৌদি আরবে ইন্তেকাল করেন তরুণ লেখক মাওলানা রায়হান খাইরুল্লাহ। ২৩ ফেব্র“য়ারি (রোববার) ইন্তেকাল করেন তিনি। তারা বাবা মুফতি খাইরুল্লাহ কারওয়ান বাজার আম্বরশাহ মাদ্রাসার মুহতামিম।
বিশ্বজয়ী হাফেজ ত্বকী : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের গৌরব ছড়িয়ে দেয়া হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি ইন্তেকাল করেন ২৮ অক্টোবর।  তিনবারের বিশ্বজয়ী হাফেজ সাইফুর রহমান কুয়েত ও বাহরাইনে কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। বিশ্বের একাধিক দেশে কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকী। ২০১৭ সালে জর্ডানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৬২টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম হন হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকী। পরবর্তী সময়ে কুয়েত ও বাহরাইনেও তিনি কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন।