খুলনা | শুক্রবার | ১১ জুলাই ২০২৫ | ২৭ আষাঢ় ১৪৩২

আল্লাহর ধ্যান সব আমলের জান

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৩৫ এ.এম | ১২ নভেম্বর ২০২১


প্রত্যেক আমলের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ বা ধ্যান হলো সেই আমলের জান। যে আমলে আল­াহর ধ্যান নেই, সে আমলের কোন দাম নেই। দুনিয়াতেও দাম নেই, আখেরাতেও দাম নেই। প্রকৃতপক্ষে, প্রত্যেকটি কাজে মহান আল­াহতায়ালাকে স্মরণ করার নামই হলো জিকির। যে কোন আমল, ছোট হোক বা বড়, তা যদি আল­াহর ধ্যানে ও মহব্বতে করা হয় তাই জিকিরের মধ্যে গণ্য হবে। সব আমলের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো আল­াহর জিকির বা আল্লাহর ধ্যান। যেমন : নামাজের ব্যাপারে বলা হয়েছে, আকিমিচ্ছলাতা লি যিকরি। অর্থাৎ তোমরা নামাজ পড়ো আল­াহকে স্মরণ করার জন্য (আল কোরআন)। কোরআন তেলোওয়াত, তাসবিহ পাঠ তওবা, এস্তেগফার, দোয়া সবই জিকিরের অন্তর্ভূক্ত।
জিকির সর্বশ্রেষ্ঠ আমল এবং সমস্ত আমলের উদ্দেশ্যই হলো মহান আল্লাহর জিকির বা স্মরণ। আল­াহপাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন : ওয়ালাযিকরুল্লাহি আকবার...। অর্থাৎ আল্লাহর জিকির সর্বশ্রেষ্ঠ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)। অন্যত্র বলা মনে হয়েছে, জ্ঞানী লোক তারাই যারা দাঁড়ায়ে, বসে, শুয়ে- সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করে ( সূরা আল ইমরান : ১৯১)। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন : আমি কি তোমাদিগকে এমন আমল বলে দিব না, যা তোমাদের আমলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম, তোমাদের মালিকের কাছে সর্বাপেক্ষা পবিত্র, তোমাদের মর্যাদাকে সর্বাপেক্ষা উন্নতকারী, সোনা-রুপা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা অপেক্ষাও উত্তম এবং জিহাদে তোমরা শত্র“কে কতল করো আর তারা তোমাদেরকে কতল করে ইহা থেকেও উত্তম? সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আরজ করলেন, অবশ্যই বলে দেন হে আল্লাহর রসুল। তিনি এরশাদ করলেন, সেটা হলো আল্লাহর জিকির (তিরমিজি)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুসর (রাঃ) হতে বর্ণিত : এক সাহাবি হুজুর (সাঃ) কে জিজ্ঞাস করলেন, ইয়া রসুলাল­াহ (সাঃ) শরীয়তের হুকুম তো অনেক আছে, আমাকে এমন কোন আমল বলে দিন যা আমি সর্বদা আমল করতে পারি। তিনি এরশাদ করলেন, তোমার জিহŸা যেন সবসময় আল­াহর জিকিরে সিক্ত থাকে (তিরমিজি)। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, বিদায়কালে (তিনি যখন ইয়ামানের আমির নিযুক্ত হয়ে বিদায় নিচ্ছেলেন) প্রিয়নবী (সাঃ)-এর সাথে আমার শেষ কথাবার্তা যা হয়েছিল তা এই ছিল যে, আমি জিজ্ঞাস করলাম, সমস্ত আমলের মধ্যে আল­াহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি এরশাদ করলেন, এমন অবস্থায় তোমার মৃত্যু আসে যখন তোমার জিহŸা আল্লাহর জিকির দ্বারা সিক্ত থাকে (বাযযার, মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)।
জিকির কারীকে নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের মাঝে গর্ব করেন। আল্লাহপাক এরশাদ করেন : তোমরা আমাকে স্মরণ করো, তাহলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো (সূরা বাকারা : ১৫২)। হাদিসে আছে, মহান আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। আর যে কোন মজলিশে আমাকে স্মরণ করে আমি তাকে নিয়ে উচ্চতর মজলিশে (ফেরেশতাদের মজলিশে) স্মরণ করি (বুখারি)। আল্লাহপাক এরশাদ করেন : সকাল-সন্ধা মনে মনে, বিনয়, ভয় ও নিম্নস্বরে (কোরআন পড়ে বা তাসবিহ পড়ার মাধ্যমে) আপন রবকে স্মরণ করতে থাকো এবং গাফেল থেকো না (সূরা আ’রাফ : ২০৫)।
জিকির মনের দুচিন্তা দূর করে। চেহারা ও অন্তরকে নূরানী করে। অন্তরের প্রশান্তি একমাত্র জিকিরের মধ্যেই আছে। এ প্রসঙ্গে আল­াহপাক এরশাদ করেন : ভালো করে জেনে রাখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর শান্তি পায় (সূরা রা’দ : ২৮)। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি মহব্বত পয়দা হয়। আল­াহর মারেফাতের দরজা খুলে যায়। বান্দার দিলের মধ্যে আল­াহর ভয় ও বড়ত্বের ইয়াকিন পয়দা হয়। জিকির দিলের জং বা মরিচা দূর করে। হাদিসে আছে, প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে সেই জিনিস হিসেবে মরিচা ও ময়লা পড়ে। দিলের মরিচা ও ময়লা হলো খাহেশাত ও গাফেলত। জিকির বা আল্লাহর স্মরণ এই মরিচাকে দূর করে দেয়। জিকির দিরকে নরম করে। মানুষের দিলের ভিতরে এক ধরনের কঠোরতা আছে জিকির ছাড়া কোন কিছু দ্বারা নরম হয় না। জিকির দিলের যাবতীয় রোগের ওষুধ স্বরূপ। হদিসে আছে, সর্বদা জিকিরকারী ব্যক্তি হাসতে হাসতে জান্নাতে যাবে।
জিকির শয়তানকে দূর করে দেয় এবং তার শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়। মানুষ যখন জিকির বন্ধ করে দেয় তখন শয়তানের সাহস বেড়ে যায় এবং তাকে গোমরাহ করে। আল­াহপাক এরশাদ করেন : আর যে আল­াহ তায়ালার স্মরণ থেকে গাফেল হয় আমি তার ওপর একটি শয়তান বলবৎ করে দিই, অতপর সে সর্বদা তার সাথে থাকে ( সূরা যুখরুফ : ৩৬)। জিকির দিলকে জিন্দা করে। হাফেজ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, দিলের জন্য আল­াহর জিকির এরুপ যেমন মাছের জন্য পানি। জিকির দিল ও রুহের খোরাক। খাদ্য না পেলে শরীর যেমন দূর্বল হয়ে পড়ে, ঠিক তদ্রুপ জিকির না করলে দিল ও রুহু দূর্বল হয়ে যায়। তখন আর কোন ভাল আমল করতে ভালো লাগে না । নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল­াহর জিকির করে, আর যে জিকির করে না, তাদের উদাহরণ জীবিত ও মৃত্যের ন্যায়। জিকিরকারী জীবিত ও যে জিকির করে না সে মৃত। এক রেওয়াতে আছে যে ঘরে আল­াহর জিকির করা হয় তার উদাহরণ জীবিত ব্যক্তির ন্যায়, (অর্থাৎ আবাদ)। আর যে ঘরে আল­াহর জিকির হয় না তার উদাহরণ মৃত ব্যক্তির ন্যায় (অর্থাৎ অনাবাদ) (বুখারি, মুসলিম)। জিকির বা আল­াহর ধ্যানই হলো সব আমলের জান।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।)