খুলনা | রবিবার | ১৩ জুলাই ২০২৫ | ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

লোভ

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:২৮ এ.এম | ২১ নভেম্বর ২০২১

পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘একে অন্যের থেকে বেশি পাওয়ার লোভ বা প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলের মধ্যে ফেলে রেখেছে। এমনকি দুনিয়া পাওয়ার এ চিন্তা নিয়েই তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।’ (সূরা তাকাসুর : ১-২)
শরী’আতের পরিভাষায় লোভ হচ্ছে, কারো কোন জিনিস দেখে তা অবৈধ, মিথ্যাচার কিংবা অস্বাভাবিক উপায়ে লাভের আশা করা যা মানুষকে সর্বদাই আল্লাহ্ বিমুখ এবং দুনিয়ামুখী করে দেয়।
যদি হালাল বা বৈধ উপায়ে উপার্জনের পরও কারও মনে পরিতৃপ্তি না আসে ও তুষ্ট না হয় তাহলে বুঝতে হবে যে তাকে লোভে পেয়ে বসেছে এবং তার মনে লোভ বাসা বেঁধেছে। লোভী ব্যক্তি নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। হাতে যা আছে তাতে সুখী না থেকে অন্যায়ভাবে আরও বেশি কিছু পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। লোভ মানুষকে সামর্থের বাইরে ঠেলে দিয়ে তার বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট করে দিয়ে তাকে পাপের পথে পরিচালিত করে।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লোভের একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত উলে­খ করেছেন। আরব দেশে ছিল প্রসিদ্ধ এক লোভী। তার নাম ছিল আশআছ। সে কোথাও রওয়ানা হয়েছিল। পথিমধ্যে একদল লোককে থালা বানাতে দেখল। সে এদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা এত ছোট থালা কেন বানাচ্ছ? বড় বড় থালা বানাও। লোকেরা বলল, থালা আমরা ছোট বানাই বা বড় এতে তোমার কি যায় আসে? জবাবে সে বলল, হতে পারে যে থালা তোমরা বানাচ্ছো তা এমন ব্যক্তির হাতে পড়বে যে আমার কাছে এই থালায় করে আমার জন্য হাদিয়া তোহফা নিয়ে আসবে সুতরাং তোমরা বড় থালা বানাও। (নাফহাতুল আরব, ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)
মূলত, লোভ মানুষের অন্তরের একটি মারাত্মক ব্যাধি। আল্লাহ তা’য়ালা যে সকল নেয়ামত মানুষকে দান করেছেন তার শুকরিয়া আদায় না করে সে আরো বেশি চায় আর যদি সেটা পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে সে আবার নতুন করে আরো একটি জিনিসের প্রত্যাশা করে।
তাই রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি আদম সন্তানকে স্বর্ণে ভরা এক উপত্যকা পরিমাণ ধন-সম্পদ দেয়া হয়, তবুও সে দ্বিতীয় উপত্যকার জন্য লালায়িত থাকবে আর যদি তাকে দ্বিতীয়টি দেয়া হয় তাহলে সে তৃতীয় উপত্যকার জন্য লালায়িত থাকবে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কিছুতেই ভরবে না। তবে যে তাওবাহ করবে আল­াহ তার তাওবাহ কবুল করবেন। (বুখারী)
লোভ যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তার আল্লাহর ভয়, মানবতা, দয়ামায়া, ঈমান-আমল, বিবেক-বুদ্ধি সব লোপ পায়। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়, হঠকারিতা ও কৃপণতা পয়দা হয়। মানুষ তার মা, বাবা, ভাই-বোনসহ প্রিয়জনদের সবাইকে অবজ্ঞা করে। গরীব-দুঃখী, ইয়াতীম-মিসকীনদের দান করে না। আল­াহর রাস্তায় অর্থ খরচ করাকে তারা সম্পদের ক্ষতি মনে করে। স্বীয় বাসনা পূর্ণ করার জন্য সবাইকে ভুলে যেতে দ্বিধাবোধ করে না। টাকার মোহ, সম্পদের মোহ তাকে পাগল করে তোলে। লোভ মানুষের প্রবৃত্তি পরায়ণতাকে উসকে দেয়, প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের দিকে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। এ সব অপকর্ম দ্বারা যেমনিভাবে তার আত্মা দুর্বল হয়, অনুরূপভাবে তার শরীর বা দেহও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। লোভের কারণেই মানুষ নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থপর হয়। এছাড়াও চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, বোমাবাজি, খুন-খারাবিসহ অধিকাংশ সামাজিক বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে। মানুষ যখন লোভ-লালসার ভিতরে থাকে তখন সে হালাল হারাম বিচার না করে বিভিন্ন পন্থায় তার কাক্সিক্ষত বস্তুটি পেতে চেষ্টা করে। তখন সে কোন অপরাধকেই অপরাধ মনে করে না। ফলে তার অন্তরে এক প্রকার অন্ধকার সৃষ্টি হয়, সত্য গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়, কখনো কখনো হালাল আয়ের সীমা অতিক্রম করে সে সন্দেহযুক্ত আয়ের মধ্যে প্রবেশ করে। এমনকি যুক্তি দিয়ে হারামকে হালাল করে। দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া ক্রয় করার মানসিকতা তৈরী হয়। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা ছেড়ে দেয়। মহান আল­াহ রাব্বুল আলামীনের যিকির থেকে বিরত রাখে। বান্দার আমল নষ্ট হয় এবং সাওয়াব ও বিনিময় থেকে বঞ্চিত হয়। লোভী পরিতৃপ্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, লোভী যতই পাক না কেন যেহেতু তার চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই, সেজন্য সে যতই পায় ততই চায়, তার দিল সবসময় ব্যস্ত হয়ে থাকে কখনও পরিতৃপ্ত হয় না। লোভের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। লোভীদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম।
সূরা হুমাযায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা ১ থেকে ৩ নম্বর আয়াতে লোভী ব্যক্তিদের প্রকৃতির উদাহরণ দিয়ে ৪ নম্বর আয়াতে তাদের চির শাস্তির কথা বলেছেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে (উদ্ধত দেখিয়ে), যে অর্থ জমা করে এবং গণনা করে, সে মনে করে যে তার অর্থ-সম্পদ চিরদিন তার সাথে থাকবে। কখনো নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে চূর্ণ-বিচূর্ণকারী জাহান্নামে।’ (সূরা হুমাযাহ : ১-৪)
রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা লোভ করবে তারা কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (তাবারানী)
আল্লাহই সর্বজ্ঞ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সমস্ত প্রকার লোভ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খুলনা।