খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খুলনা-২ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য নিজ দলেই অবহেলিত !

নিজস্ব প্রতিবেদক |
১০:১৮ এ.এম | ২৬ ডিসেম্বর ২০২১

ঘরে-বাইরে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্তেও খুলনা-২ আসনের সাবেক দুইজন সংসদ সদস্য নিজ নিজ দলের মধ্যে অবহেলিত। আ’লীগ ও বিএনপি’র শীর্ষ পদে থাকা এ দু’জন নেতা নিয়ন্ত্রণ করেছেন খুলনার রাজনীতিও; তাদের হাতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নতুন রাজনৈতিক কর্মীও। বর্ণাঢ্য এ দু’জন রাজনীতিক হলেন বিএনপি’র সদ্য সাবেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর শাখার সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং মহানগর আ’লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজান। দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলে তাদের রয়েছে আদ্যপান্ত জনপ্রিয়তা। রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরেও দু’জনের রয়েছে সামাজিক, উন্নয়ন ও ধর্মী সংগঠনসমূহের সাথে নিবীড় সম্পৃক্ততা। তবে নিজ দলে অবহেলার পাত্র হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মী-সমার্থকদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ।

সর্বশেষ, গতকাল শনিবার দুপুরে মহানগর বিএনপি সভাপতি পদের পর খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকেও নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এতথ্য জানানো হয়। এর মাধ্যমে প্রায় চার দশক পর খুলনা বিএনপি থেকে বাদ পড়লেন মঞ্জু। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শেষে তার এমন পরিণতি মানতে পারছেন বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা। খুলনার অন্যান্য রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের নেতারাও বিএনপির এ সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

বিএনপি কর্মীদের মন্তব্য, নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও খুলনা বিএনপি যেন একই প্রতিষ্ঠান। মঞ্জুবিহীন খুলনা বিএনপি- মানতে পারছেন না তারা। তাদের দাবি, তোষামোদকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে খুলনায় বিএনপিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো।

গত ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্র থেকে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির ৩ সদস্যের দ’ুটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে বাদ পড়েন নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও তার অনুসারীরা। দলের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে ১২ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে অমান্য করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে দেওয়া বক্তব্যকে ভালোভাবে নেননি হাইকমান্ড। বিশেষ করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষুব্ধ হন মঞ্জুর ওপর। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর শোকজ করা হয় মঞ্জুকে। ১৬ ডিসেম্বর শোকজের জবাবের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে মৌখিক শুনানির আবেদন জানান তিনি। কিন্তু তা না করেই গতকাল তাকে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়।

জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে ছাত্রদল থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ১৯৮৭ সাল থেকে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৯২ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদক, ২০০৯ সাল থেকে গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩৪ বছরে খুলনা বিএনপি এবং নজরুল ইসলাম মঞ্জু যেন এক নামেই জড়িয়ে ছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরেও সারাবছর বিভিন্ন সামাজিক কাজে দেখা যায় তাকে। এ ছাড়া ইতোপূর্বে খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য থাকার কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কারণে তিনি বাদ পড়ায় অবাক হয়েছেন খুলনার সব শ্রেণির মানুষ।

১৯৭৭ সালে জাগদল থেকে খুলনা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ইকবাল হোসেন খোকন। সোনাডাঙ্গা থানা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে থাকা প্রবীণ এ নেতা বলেন, সুসময়-দুঃসময় মাঠে-ময়দানে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকেই দেখা যায়। তাকে এভাবে বাদ দেওয়া দলের জন্য ভালো হলো না।

১৯৭৮ সালে যুবদল থেকে রাজনীতিতে রয়েছেন মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুব কায়সার। নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডে দুই দফা কাউন্সিলর তিনি। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির সঙ্গে বর্তমান দলের অনেক ফারাক। মঞ্জুসহ সিনিয়র নেতাদের যেভাবে অবমূল্যায়ন করা হলো, তাতে এদের সঙ্গে থাকায় আর রুচি নেই।

খালিশপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান মিঠু বলেন, তোষামোদকারীদের কারণে সিনিয়র নেতারা আজ মূল্যহীন। এভাবে একটি দল চলতে পারে না।

সার্বিক বিষয় নিয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি কখনও সিদ্ধান্ত অমান্য করিনি। আমি বলেছি, বিএনপি ভালোমানুষের দল হোক; প্রকৃত ত্যাগী, পরীক্ষিতদের দিয়ে কমিটি হোক। খুলনা বিএনপির কমিটি গঠনের আগে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক। এ জন্য আমি ২৭ পাতার দীর্ঘ চিঠি দিয়েছি। তিনি বলেন, আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। খুলনায় সবচেয়ে বড় জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের ওপর এটা বড় একটা আঘাত।

আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজান : নগরীর ব্যস্ততম সাতরাস্তা মোড় এলাকায় সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজানের ব্যক্তিগত কার্যালয়। ক’বছর আগেও ওই কার্যালয় ও তার আশপাশে নেতাকর্মীদের ভীড় লেগেই থাকতো। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সঙ্গে থাকতেন অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। কার্যালয় ঘিরে এখন আর সেই ভিড় নেই, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে তাঁকে আর কোনো অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেও দেখা যায় না। যদিও দীর্ঘ বিরতির পর সম্প্রতি দলীয় ও সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি।

জানা গেছে, একসময় খুলনা নগর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহানগর সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের। ২০০৮ সালে মেয়র হওয়ার পর তাঁর আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে হেরে যান খালেক। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজান। এরপর মিজানুর রহমান মিজানের দলীয় অনুসারী বৃদ্ধি পায় ও আধিপত্য গড়ে তোলেন। বিভিন্ন সংগঠন নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ী, পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীদের তালিকায় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মিজানুর রহমানের নাম রয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের জবাবদিহির সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাঁকে। মিজানকে খুলনা-২ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। তবে ২০১৮ সালের অক্টোবরের শুরু থেকে গুঞ্জনে উঠে আসে শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের নাম। ওই বছর ২৫ অক্টোবর খুলনায় আসেন সেখ সালাহউদ্দিন। ওই দিন বর্ধিত সভায় তাঁকে খুলনা-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।

এরপর ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনা জেলা ও মহানগর আ’লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে নগর আওয়ামী লীগে তালুকদার আব্দুল খালেককে পুনরায় সভাপতি এবং এমডিএ বাবুল রানাকে নতুন করে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এখানেই বাদ পড়ে যান আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজান। সম্মেলনের প্রায় ১৩ মাস পর গত বছরের ৩ জানুয়ারি খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের ৭৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ৫নং সদস্যের স্থলে স্থান হয় তার।

যদিও এসব নিয়ে ক্ষোভ নেই তার। আলহাজ¦ মিজানুর রহমান মিজান বলেন, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পৈত্রিকসূত্রেই আ’লীগের রাজনীতি করি। দল যখন যাকে যেখানে প্রয়োজন দায়িত্ব দিতেই পারেন। তবে আমি তো দলের সাথেই আছি, নেতাকর্মীদের মাঝেই থাকি। বাকীটা জীবন খুলনাবাসীর সাথেই বাঁচতে চাই।