খুলনা | রবিবার | ০৬ জুলাই ২০২৫ | ২২ আষাঢ় ১৪৩২

পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে তাদের জন্য সন্তানের করণীয়

ধর্ম ডেস্ক |
০৩:৫০ পি.এম | ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২২


আলোকিত নয়নাভিরাম এই পৃথিবীতে কত চেনা মুখ, কত স্বজন প্রিয়জন। কত মানুষের মুখ প্রতি দিন দেখি আমরা। কিন্তু এত মানুষের ভীড়ের মাঝেও মা বাবার মত প্রিয়জন কি কেউ আছেন আর? তাদের মত করে কেউ নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয় আমাদের বিশুষ্ক মুখগুলো? তাদের মত করে স্বার্থহীন মমতার হাত বুলিয়ে দেয় আমাদের মাথায়? বস্তুতঃ কেউ নেই। কিছু নেই। মা বাবা নেই তো মনে হবে, দম বন্ধ করা এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাদের মত প্রাণের অধিক আপন আর কেউ নেই। এই পৃথিবীর মুখ আমরা দেখেছি মা-বাবার মাধ্যমেই। মা-বাবা ছোট শব্দ, কিন্তু এ দুটি শব্দের সাথে কত যে আদর, স্নেহ, ভালোবাসার গাঢ় গভীর বন্ধন জড়িয়ে রয়েছে তা পৃথিবীর কোনো পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। মা-বাবা কতই না কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য, না খেয়ে থেকেছেন, অনেক সময় ভালো পোশাকও পরিধান করতে পারেননি, কত না সময় বসে থাকতেন সন্তানের অপেক্ষায়। কত শখ আহলাদ, আমা প্রত্যাশা আর স্বপ্ন স্বাদকে বিসর্জন দিয়েছেন মা বাবা। আমাদের জন্য। শুধুই আমাদের জন্য। এমন দরদি মা বাবা যাদের ছেড়ে চির দিনের জন্য চলে গিয়েছেন, তারাই বোঝেন মা বাবা কত বড় সম্পদ। যেদিন থেকে মা বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন থেকে মনে হয় কী যেন হারিয়ে গেল, সেদিন থেকে বুকটা হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে কেঁপে ওঠে, চোখ থেকে বৃষ্টির মতো অঝোর ধারায় পানি ঝরে। জানি, শান্তনার এমন কোনো বাণী নেই যা মাতা পিতার অভাবকে পূরণ করতে পারে। মাতা পিতার স্নেহের পরশ পৃথিবীতে আর কোথাও কেউ দিতে পারে না।

মা বাবা যাদের চলে গিয়েছেন তাদের জন্য কিছু করণীয় রয়েছে। কবর জগতে মা বাবার প্রশান্তির জন্য, তাদের মাগফিরাতের জন্য সন্তানের রয়েছে কিছু করণীয়। বক্ষমান নিবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মৃত মা-বাবা জন্য কী ধরনের আমল করা উচিত এবং যে আমলের সওয়াব তাদের নিকট পৌঁছবে তা উল্লেখ করার প্রয়াস পাব ইন-শা-আল্লাহু তাআ'লা।

এক. মা বাবার জন্য বেশি বেশি দোয়া করা

মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশি বেশি দু’আ করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দু’আ করবো তাও তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন। আল কুরআনে এসেছে,

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছগিরা’

অর্থাৎ “হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। -সূরা বানি ইসরাঈল : ২৪

পবিত্র কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে,

رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ

‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে মা করে দিন’। -সুরা ইবরাহীম : ৪১

এছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পিতা-মাতার জন্য দু’আ করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন-

رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا

‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে মাফ করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি জালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না’। -সূরা নূহ :২৮

তবে মা-বাবাকেও এমন সন্তান রেখে যেতে হবে যারা তা পিতা-মাতার জন্য দোয়া করতে পারবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না- ১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান, যে তার জন্য দু‘আ করে। -সহিহ মুসলিম : হাদিস নং ৪৩১০

দুই. সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রদান করা

মা-বাবা বেঁচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেননি বা বেঁচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে, আয়েশা রা. বলেন- ‘জনৈক ব্যক্তি রা. এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই কোনো অছিয়ত করতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।” -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ২৩৭৩

তবে উত্তম হবে, সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান অর্থাৎ চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন- পানির কূপ খনন করা, নলকূপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা ইত্যাদি।

তিন. তাদের পক্ষে সিয়াম পালন

মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোনো মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিশগণ রোজা রাখবে’। -সহীহ বুখারী : হাদিস নং ১৯৫২

চার. হজ বা উমরাহ করা

মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, ‘জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা হজ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ স. বললেন, 'তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার ওপর ঋণ থাকত তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা তুমিই আল্লাহর দাবি পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’। -সহীহ বুখারি : হাদিস নং ১৮৫২

তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।

পাঁচ. মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানি করা

মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানি করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানির জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ স. আয়েশাকে রা. বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি জবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে কবুল কর”। -সহীহ মুসলিম: হাদিস নং ৫২০৩

ছয়. ওসিয়ত পূর্ণ করা

মা-বাবা শরীয়াহ সম্মত কোনো ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের ওপর দায়িত্ব। রাশীদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফী রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ স. কে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল স. বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও, কেন না সে মু’মিনা। -সহীহ ইবন হিববান :১৮৯

সাত. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা

মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া, তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রা. আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রা. এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রা. উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিল তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রা. বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ, সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায় (এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রা. বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রা. এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি 'পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় কাজ? সওয়াবের কাজ’। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ৬৬৭৭

মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূল স. এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই কোনো বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ৬৪৩১

আট. পিতা-মাতার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখা

সন্তান তার মা-বাবার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালোবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ -সহীহ ইবন হিববান : ৪৩২

নয়. মা-বাবার ঋণ পরিশোধ করা

মা-বাবার কোনো ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের ওপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা. ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়, যতক্ষণ তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। -সুনান ইবন মাজাহ : ৪১৩

ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয় । হাদীসে আরো এসেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। -নাসায়ী ৭/৩১৪; তাবরানী ফিল কাবীর ১৯/২৪৮; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৯

দশ. কাফফারা আদায় করা

মা-বাবার কোনো শপথের কাফফারা, ভুলকৃত হত্যাসহ কোনো কাফফারা বাকী থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (মাফ) করে দেয় (তাহলে সেটা ভিন্ন কথা)। -সূরা আন-নিসা : ৯২

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কসম খেয়ে শপথ করার পর তার থেকে উত্তম কিছু করলেও তার কাফফারা অদায় করবে’। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ৪৩৬০

এ বিধান জীবিত ও মৃত সবারক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। দুনিয়ার বুকে কেউ অন্যায় করলে তার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে কেউ অন্যায় করে মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা প্রদান করবেন।

এগারো. ক্ষমা প্রার্থনা করা

মা-বাবার জন্য আল্লাহর নিকট বেশি বেশি মা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য মা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। হাদীসে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কোনো বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে হে আমার রব, আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কিভাবে এ আমল আসলো? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য মা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছো’। -আল-আদাবুল মুফরাদ : হাদিস নং ৩৬

বারো. মান্নত পূরণ করা

মা-বাবা কোনো মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, ‘কোন মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট আসলে তিনি বলরেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। -সহীহ ইবন হিববান : হাদিস নং ২৮০

তের. মা-বাবার ভালো কাজসমূহ জারি রাখা

মা-বাবা যেসব ভালো কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরি করা, মাদরাসা তৈরি করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসেবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভালো কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীসে এসেছে, ‘ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’। -সুনান আত তিরমীযি : হাদিস নং ২৬৭০

যে ব্যক্তির ইসলামের ভালো কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না’। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ২৩৯৮

চৌদ্দ. কবর জিয়ারত করা

সন্তান তার মা-বাবার কবর জিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, অতঃপর মুহাম্মাদের মায়ের কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর জিয়রাত কর, কেননা তা আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। -সুনান তিরমীযি : হাদিস নং ১০৫৪

অন্য হাদিসে বলা হয়েছে- তোমরা কবর জিয়রাত কর, কেননা তা আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। -সুনান তিরমীযি : হাদিস নং ১০৫৪

কবর জিয়ারতের জন্য কোনো দিনকে নির্দিষ্ট করার বিধান নেই। এমনটি করা যাবে না। কবর জিযারত যখন খুশি, যে দিন খুশি করা যাবে। কবর জিয়ারতের সময় হাদিসে বর্ণিত এ দোয়া পড়বে-

- اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ اِنَّا اِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ

উচ্চারণ : ‘আসসালামু আলাইকুম দারা ক্বাওমিম মুমিনিনা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুন।’

কবরবাসী মুমিন-মুসলিম আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক । নিশ্চয় আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হবো। -সুনান ইবন মাজাহ : হাদিস নং ১৫৪৭ সহিহ মুসলিম

এ ছাড়া নিচের সূরা এবং দরূদ পাঠ করে দোআ করা উত্তম।

- দরুদ শরিফ পড়া।
- সুরা ফাতিহা পড়া।
- সুরা ইখলাস পড়া।
- আয়াতুল কুরসি পড়া।

কবর জিয়ারতের জন্য বিশেষ দিন ক্ষন না থাকলেও সাধারণভাবে সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমুআর দিন উত্তম হওয়ায় এবং সুন্নাত আমল হিসেবে এই দিনে কবর জিয়ারতের বিশেষ ফায়দা ও ফজিলত রয়েছে। জুমুআর দিন কবর জিয়ারত করলে জিয়ারতকারীর জন্যও তা ক্ষমালাভের কারণ। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি জুমআয় তার মা-বাবা বা তাদের একজনের কবর জিয়ারত করবে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে।’ -আল মুজামুল আউসাত

পনেরো. ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা

মা-বাবা কারো সাথে কোনো ভালো কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তারা বেঁচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। -সূরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৪

ষোল. কোনো গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা 

মা-বাবা বেঁচে থাকতে কোনো গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহ্বান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোনো কমতি হবে না। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ৬৯৮০

সতেরো. মা-বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া

মা-বাবা বেঁচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো ওপর জুলুম করে থাকলে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবে। কেননা হাদীসে এসেছে, ‘আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরিব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরিব যে, কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিপে করা হবে। -সুনান আত তিরমিযি : হাদিস নং ২৪২৮

শেষের প্রার্থনা 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নিকট কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে তাওফিক দান করুন যেন আমরা আমাদের পিতা মাতার খেদমত করে তাদের চক্ষু শীতল করতে পারি। আমাদের পিতা মাতাদের ইহ পরকালে সর্বোত্তম কল্যানে ভূষিত করুন। মৃত্যুর পরে জান্নাতে উঁচু মর্যাদায় সমাসীন করুন।