খুলনা | শনিবার | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, সাতটি সুপারিশ

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলেন উপাচার্য পরিবারের নয় সদস্য

নিজস্ব প্রতিবেদক |
১২:২৩ পি.এম | ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২২


খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অন্তত ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে উঠে এসেছে উপাচার্যের এমন অনিয়মের চিত্র। ইউজিসির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গত মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এতে নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের নানা অপকর্মের ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।

ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ ছিলেন ওই কমিটির প্রধান। বাকি দুই সদস্য হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্কিটেকচার অনুষদের ডিন আফরোজা পারভীন এবং ইউজিসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোঃ গোলাম দস্তগীর।

তদন্ত দলের প্রধান অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ জানান, তদন্তে যা কিছু উঠে এসেছে তার সবই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে আমার বা কমিটির কোনো কথা নেই।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপাচার্য শহীদুর রহমান খান নিজ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে কমপক্ষে ৯ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দিনকে নিয়োগ দিয়েছেন শাখা কর্মকর্তা পদে। চারজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যারা উপাচার্যের ভাতিজা। ভাতিজারা হচ্ছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল­াহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান। উপাচার্যের শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল­াহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। এছাড়া নিকটাত্মীয় নিজাম উদ্দিনকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। তাদের সবাইকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি ত্র“টিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কারণ, তিনি অন্য প্রার্থীর চেয়ে শিক্ষাজীবনের ফলাফলে পিছিয়েছিলেন। 

তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের মেয়েকে নিয়োগ প্রক্রিয়াতে স্বজনপ্রীতি ও ত্র“টি পরিলক্ষিত হয়েছে। নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম ছাতক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এই নিয়োগ স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি বলছে, উপাচার্যের স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেননি।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্যের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রয়েছে উৎকোচের অভিযোগ। 

সূত্রটি আরও জানায় জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে খুলনার স্থানীয় প্রার্থীদেরকে কৌশলে বাদ দিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্যের নিজ জেলা নোয়াখালী, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের নিজ জেলা নরসিংদী এবং উপাচার্যের স্ত্রীর নিজ জেলা বরিশালের লোকজনকে একচেটিয়া নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

উলে­খ্য, ২০১৫ সালের ৫ জুলাই জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ শহীদুর রহমান খান। তিনি ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রেজিস্ট্রার পদের বিপরীতে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে ছয় মাসের জন্য অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন ডাঃ মোঃ মাজহারুল আনোয়ারকে। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাতজন সহকারী অধ্যাপক, একজন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ১৪ জন প্রভাষকসহ ২৯ ধরনের পদের জন্য ৭৬ জন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেই থেকেই অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ ও স্থানীয় প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে কৌশলে একের পর এক বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। রেজিস্ট্রার সার্বজনীন পদ হলেও ‘কৃষি সংশ্নিষ্ট বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর’ এর শর্ত আরোপ করা হয়, যা দেশের অন্য কোনো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। রেজিস্ট্রার মূলতঃ প্রশাসনিক পদ। খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজেই সেই পদের জন্য প্রার্থী হন।

ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাইক্রোবায়োলজি এ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া মোঃ আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞপ্তিতে উলে­খ করা যোগ্যতার চেয়ে কম। তিনি ডিভিএমে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং এমএসসিতে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। 

তবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, প্রার্থীকে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ন্যূনতম সাড়ে ৩ পেতে হবে। এই শর্ত শিথিল করা যাবে, যদি প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রি থাকে। আশিকুল আলমের পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। জানা যায়, তিনি উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের অধীনে গবেষণারত ছিলেন।

ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদনে সহকারী অধ্যাপক আশিকুল আলম-এর শিক্ষক হিসেবে পাওয়া নিয়োগটি ত্র“টিপূর্ণ হওয়ায় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়।

নিয়োগে অনিয়ম ও ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করেও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।