খুলনা | রবিবার | ২২ জুন ২০২৫ | ৮ আষাঢ় ১৪৩২

হিজাব নিয়ে এত বিতর্ক কেন!

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:২১ এ.এম | ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২


২০০৯ সালের কথা। তখনও ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ হয়নি। আমি তখন ফ্রান্সে ছিলাম উচ্চ শিক্ষার জন্য। থাকতাম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। প্রথম আমি যখন বাংলাদেশ থেকে প্যারিসে যাই, তখনই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়। নামলাম ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর শারদেগুলে। বিমানবন্দরে এক সময় নামাজের জন্য জায়গা খুঁজছিলাম। দেখলাম নামাজের জন্য সুন্দর একটি জায়গা করা আছে। এরপর এখান থেকে রাজধানী প্যারিসে আসলাম প্রথমে ট্রেন ও পরে মেট্রোরেলে। মেট্রোরেল থেকে সুড়ঙ্গ বেয়ে উপরের দিকে উঠেই পৌঁছে গেলাম রাজধানী প্যারিসে। স্টেশনে পৌঁছেই ফ্রান্স সম্পর্কে আমার পূর্বের ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। মনে হলো কোন এক মুসলমান দেশে আসলাম। লোকে লোকারণ্য সেন্ট্রাল স্টেশন। চোখে পড়লো অনেক হিজাব পরা মহিলা। পুরুষদের বেশভ‚শা দেখেও মনে হলো এখানে অনেক মুসলমান। পরবর্তিতে জানতে পারলাম খোদ ফ্রান্সেই রয়েছে সাড়ে তিনশ’র মতো মসজিদ ও পাঞ্জেগানা নামাজের জায়গা। জনসংখ্যার ১০ ভাগেরও বেশি মুসলমান। দ্বিতীয় ভাষা আরবী। আমার এই সুধারণাটাই পরবর্তিতে চিন্তায় পরিণত হলো। আর একদিন যাচ্ছিলাম ট্রেনে। মনে নেয় কোথায় কবে। ট্রেনের ভিতরেই কয়েকজন কথোপকথন করছিল। শুনছিলাম পাশ থেকে। তাদের আলোচনার বিষয় হলো, ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বিমান বন্দর, বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন গেলেই চোখে পড়ে অসংখ্য বোরকা আর হিজাব পরা মহিলা। এটাই এখন কট্টোর উগ্রবাদী গোষ্ঠির মাথা ব্যথার কারণ। তারাই ফ্রান্স সরকারকে বুঝাচ্ছে যে, এভাবে চলতে থাকলে মানুষের ধারণাটাই খারাপ (!) হয়ে যাবে। বাইরে থেকে মানুষ স্টেশন গুলোতে আসলেই মনে হবে এটা মুসলিম কোন দেশ। এই কারণে মুসলমানদের হিজাব নিষিদ্ধ করা দরকার। আমি পাশে বসে তাদের মন্তব্যগুলো শুনছিলাম, আর দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছিল। বাস্তবেও হলো তাই; এর বেশ কয়েক বছর পর ফ্রান্সে জনসম্মুখে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হলো। ফ্রান্সকে গুরু মেনে আরও কয়েকটি দেশ হিজাবের বিরুদ্ধে গেল। স¤প্রতি করোনাকালীন সময়েই শ্রীলঙ্কায় মুসলিম মহিলাদের বোরকা বা হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের এই বিরোধিতার কারণ মূলত সন্ত্রাস বা সামাজিক নিরাপত্তা নয়। তাদের চিন্তা অন্যখানে; কেন মুসলমানের সংখা বেড়ে যাচ্ছে।
অতি স¤প্রতি, হিজাবের প্রতি বিষোদ্বগারের নগ্ন রূপ দেখলাম ভারতের কর্ণাটকে। এক মুসকানকে ঠেকাতে শত শত উগ্রপন্থী। অথচ হিন্দু ধর্মেও শরীর আবর্তন করে শালীনতার পোশাকের কথা বলা আছে। তাদের পক্ষ নিয়ে খোদ আদালতও পক্ষপাত দুষ্ট। এই সত্য কথাটা আদালত বলতে পারেছ না, যার ধর্ম সে পালন করবে। এটা ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত। প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। যে পছন্দ করবে, তার ধর্মীয় পোশাক সে পরবে। কেউ কাউকে বাধা দিবে না।
হিজাব নিশ্চয় অশালীন পোশাক নয়? আমার মনে হয়, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শালীন পোশাক যা মানুষকে হাজারো সামাজিক ব্যাধি থেকে বাঁচাবে। এর আগে এই কলামে আমি লিখেছিলাম যে, করোনার মাস্ক এবং ইসলামের হিজাবের মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই, হিজাব শুধু মহিলারা পরে, আর করোনার মাস্ক পরছে নারী-পুরুষ সকলে মিলে। করোনা বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ওয়ান-টাইম সাধারণ সার্জিক্যাল পাতলা মাস্কের চেয়ে মোটা কাপড়ের মাস্ক অধিক সুরক্ষা দানকারী। করোনার পিপিই বা পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট বলতে যা বুঝায়, তার সাথে হিজাবের তেমন কোন পার্থক্য নেই। তার পরেও স¤প্রতি শ্রীলঙ্কায় বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে ফ্রান্সসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ তারাই দেশে আইন পাশ করেছে যে, মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। অনেক দেশে তো মাস্ক না পরার কারণে অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে মাস্ক পরতে বাধ্য করা কি নিছক একটি বোকামি, নাকি অহেতুক কাজ? এতে ব্যক্তি স্বাধীনতায় কোন ব্যাঘাত ঘটে না? এর উত্তরে আইন বিশেষজ্ঞগণ ও স্বাস্থ্য-বিশষেজ্ঞগণ বলবেন, তা কখনই নয়। এটা জনস্বার্থে। জনসম্মুখে মহিলাদের বোরকা পরতে নিষেধ করার পিছনে যুক্তি দেখানো হয় যে, এটা দেশের নিরাপত্তা বিরোধী, সিকিউরিটি কনসার্ন। কারণ, মুখ ঢেকে কেউ সন্ত্রাসী কাজ করলে বুঝা যাবে না যে কে এই আকামটা করলো। এই কারণে হিজাব পরা যাবে না। বেশ ভালো কথা! তাহলে মুখে মাস্ক পরলে, আর ফেস শিল্ড ও হেড শিল্ড ব্যবহার করলে এটা সিকিউরিটি কনসার্ন বা নিরাপত্তা বিরোধী হবে না? জনসমাগমে মাস্ক পরলেও তো কাউকে চেনা যাবে না। মাস্ক পরে সন্ত্রাসী কাজ করলেও তো বোঝা যাবে না, কে করলো। তাহলে শুধুমাত্র হিজাবের প্রতি এই বিমাতাসূলভ আচরণ কেন? এটা ইসলামফোবিয়া (ইসলামভীতি) ও ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তারা ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে। কিন্তু মুসলমানদের প্রশ্নে তাদের এই সমস্ত বুলি কোথায় উবে যায়? হিজাব নিয়ে ভারতের কর্ণাটকে যা ঘটে গেল তার আমরা নিন্দা জানাই। সারা বিশ্বে আজ মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা। আর এটাই ইসলাম বিরোধীদের মাথা ব্যাথার কারণ। হিজাবের প্রতি আক্রোশ, এরই বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নই।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।)