খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ পৌষ ১৪৩১

‘যে বড়দের সম্মান করে না সে নবীর প্রকৃত উম্মত নয়’

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৩৫ এ.এম | ০৭ মে ২০২২


এক সময় আমরা সবাই ছোট্ট শিশু ছিলাম। এখন কেউ কিশোর, কেউ যুবক, কেউ প্রবীন। এক সময় আসবে যখন আমরা সবাই বৃদ্ধ হয়ে যাবো। অর্থাৎ কেউ ছোট, কেউ বড়। এভাবে ছোট-বড় সবাইকে নিয়েই গড়ে ওঠে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ। বড়রা যেমন ছোটদের স্নেহ করবে, ঠিক তেমনি ছোটরা বড়দের করবে সম্মান। এভাবেই একটি সমাজ হয়ে উঠবে সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ। পক্ষান্তরে, এই শিক্ষার ব্যতিক্রম হলে, পরিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলার সূত্রগুলো ছিন্ন করা হলে, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা তুলে দেওয়া হলে, সেই সমাজ পরিণত হবে এক উচ্ছৃঙ্খল সমাজে।
ইসলামে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের গুরুত্ব :
বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মানবিক গুণাবলির মধ্যে একটি অন্যতম গুণ। এটা ইসলামেরও শিক্ষা। সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যারা বড়দের শ্রদ্ধা করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত নয়। অর্থাৎ সে আমার প্রকৃত অনুসারি নয়। একজন ভালো মানুষ হতে হলে আমাদের অবশ্যই বড়দের সম্মান করতে হবে। মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের বড় হতে পারে। যেমন : কেউ বয়সে বড়, কেউ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় বড়, কেউবা পদ-মর্যাদা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে বড়। হাদীস শরীফে অতি গুরুত্বের সাথে বৃদ্ধ মুসলিমের মর্যাদা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বৃদ্ধকে সম্মান করা মানবিকতা। শুধু তা-ই নয়, ইসলামের বার্ধক্য মহিমান্বিত। এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইসলামের মাঝে বাধর্ক্যে উপনীত হয়, তার বার্ধক্য কিয়ামতের দিন তার জন্য নূর হবে (জামে তিরমিযী)। একজন মুসলিম ঈমানের হালতে যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন আল­াহ পাকের কাছে এটা অতি মর্যাদার বিষয়। এই বার্ধক্যের মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি। আরেক হাদীসে আছে, হযরত আবু মুসা আশআরী (রা.) আল­াহর রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম থেকে বর্ণনা করেন, আল­াহ পাককে সম্মান করার একটি দাবি, বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা (আবু দাউদ)। অন্য হাদিসে আছে, তিন ব্যাক্তিকে একমাত্র মুনাফিকই অসম্মান করতে পারে। এক. বৃদ্ধ মুসলমান, দুই. কুরআনের ওই রক্ষক যে তাতে কম বেশি করে না এবং তিন. ন্যায় পরায়ন বাদশাহ। এ একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি ছোট বয়সে বড়দের সম্মান করি, তাহলে আমরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবো তখন অন্যান্য কিশোররাও আমাদের শ্রদ্ধা করবে। এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, যে যুবক কোনো বৃদ্ধের প্রতি তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান প্রদর্শন করবেন, আল­াহতায়ালা সেই যুবকের শেষ বয়সে তার প্রতি সম্মানকারী লোক পয়দা করবেন। আল­াহ’র রসূলের কথা পূর্বে কখনও মিথ্যা হয়নি; ভবিষ্যতেও হবে না। 
বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন কিভাবে?
আমরা বিভিন্নভাবে বড়দের সম্মান করতে পারি। যেমন :
* বড়দের সাথে দেখা হলে সালাম দেওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় করা, খোঁজ-খবর নেওয়া।
* তাদের নাম ধরে না ডাকা, বয়স অনুপাতে তাকে সুন্দরভাবে সম্বোধন করা, যেমন : আব্বু, আম্মু, চাচাজি, দাদাজি ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা।
* তাদের সাথে উঁ”ু আওয়াজে কথা না বলা, তর্ক-বিতর্ক না করা।
* বড়রা যদি তাদের ইচ্ছায় হাত বাড়ায় তাহলে মোসাফাহ করা; নইলে নয়।
* তারা যখন কথা বলে তখন তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনা। কথার মধ্যে কথা না বলা।
* বড়দের কথাকে প্রাধান্য দেওয়া। এক হাদীসে আছে, কয়েকজন লোক একটি হত্যা-ঘটনা নিয়ে মহানবীর কাছে আসলেন। নিহতের সন্তানদের মধ্যে যে ছোট সে এ বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আল­াহর রসূল (সা.) তাকে থামিয়ে দিয়ে বড় ভাইকে কথা বলার আদেশ করলেন (আবু দাউদ)।
* তাদের আগে পথ না চলা, বরং তাদের পিছনে পিছনে চলা।
* বড়দের উপদেশ ও কথা মান্য করা।
* তারা যখন সাহায্যের মুখাপেক্ষি হয়, তখন সাহায্য করা। যেমন : কোন বৃদ্ধ মানুষ পথে পড়ে গেলে তাকে তোলা, পথ হারিয়ে ফেললে তার পথ দেখানো ইত্যাদি।
ক্স গাড়িতে সম্ভব হলে তার বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া। উন্নত দেশে আমরা দেখেছি, সেখানে বয়স্কদের জন্য প্রত্যেকটি গাড়িতেই আলাদা সীটের ব্যবস্থা আছে। সেখানে শুধুমাত্র বয়স্ক ও দুর্বলরাই বসতে পারে।
ক্স উন্নত দেশে  বড়দের আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়। সেখানে বয়স্কদের গণ্য করা হয় সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে; তাদের জন্য বাস-ট্রেন, এমনটি টেক্সিতেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।
ক্স বৃদ্ধদের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা। এটা অবশ্য সরকারের দায়িত্ব। সর্বপ্রথম হযরত উমর (রা.) বৃদ্ধদের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেন। মহান আল­াহপাক আমাদের বড়দের সম্মান করার তৌফিক দান করুন এবং নবীর প্রকৃত উম্মত হিসেবে কবুল করুন।
লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।