খুলনা | রবিবার | ২২ জুন ২০২৫ | ৮ আষাঢ় ১৪৩২

করোনার মাস্ক ও ইসলামী হিজাব: মিল-অমিল

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:২৪ এ.এম | ১৪ জুলাই ২০২১

করোনা প্রতিরোধে মাস্কের ব্যবহার এবং ইসলামে হিজাবের ব্যবহার, এই দু’য়ের মধ্যে রয়েছে অপূর্ব মিল। তবে পার্থক্য এতটুকুই, হিজাব শুধু মহিলারা পরে, আর করোনার মাস্ক পরছে নারী-পুরুষ সকলে মিলে। করোনা বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ওয়ান-টাইম সাধারণ সার্জিক্যাল পাতলা মাস্কের চেয়ে মোটা কাপড়ের মাস্ক অধিক সুরক্ষাদানকারী। কাপড়ের মাস্ক দিয়ে করোনা ভাইরাস সহজে অতিক্রম করতে পারেনা। আরো অধিক সুরক্ষার জন্য ডাক্তারগণ ব্যবহার করেন পিপিই বা পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী। পিপি’র সাদামাটা মানে হলো সমস্ত শরীর আবৃত করা। পিপি’র ক্ষেত্রে হাত মোজা বা হ্যান্ড  গ্লোবস পরা হয়, স্বাভাবিক পোশাকের উপর একটি আলাদা সিনথেটিক কাপড় পরিধান করা হয়, মুখে মাস্ক দেয়া হয়, সমস্ত মাথা হেড গিয়ার দ্বারা ঢাকা হয়। ইসলামী হিজাবেরই এ যেন ভিন্ন সংস্করণ। শরয়ী হিজাব বা পর্দার ক্ষেত্রেও প্রায় সমস্ত শরীর আবৃত করা হয়। হিজাব পরলে করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রায় সবগুলো নীতিই মানা হয়। পর্দার বিধান ইসলামের সৌন্দর্য্য, সকলের জন্যই উপকারী। হাজারো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে এটা নিরাপত্তা ঢাল। এ ব্যাপারে দুইটি ঘটনা মনে পড়ল। কয়েকদিন আগে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম নিরালা জামে মসজিদে। এমন সময় দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যাক্তি প্রবেশ করল মসজিদে। মুখে মাস্ক পরা, আবার সমস্ত মুখমন্ডল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের শিট দ্বারা ঢাকা এবং উপর দিয়ে খুব শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের এই শিল্ডকে  সাধু ভাষায় বলা হয় ফেস শিল্ড বা মুখমল্ডলের ঢাল। এই ফেস শিল্ডের সঙ্গে ডাক্তারগণ ও শিক্ষিত সমাজ বেশ পরিচিত। এই ফেস শিল্ড পরেই তিনি সম্পূর্ণ নামাজ চালিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কপাল, নাক ও মাথার কোন সংযোগ নেই জায়নামাজের সাথে। ইসলামী বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন তার নামাজ আদৌ হয়েছে কি না। এটা আলোচনার বিষয় নয় এখানে। আর একদিন দেখলাম, নিরালা আবাসিক এলাকার ১ নং রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক মহিলা। তার মুখে সম্ভবত মোটা কাপড়ের মাস্ক। গায়ে স্বচ্ছ পলিথিনের একটি আস্তরণ যা অনেকটা রেইন কোটের মতো যেটা সে তার স্বাভাবিক পোশাক বা কামিজের উপর পরেছে। আর সম্পূর্ণ মুখ স্বচ্ছ প্লাস্টিকের শিট বা ফেস শিল্ড দ্বারা ঢাকা। এই মহিলা ও মসজিদের ওই পুরুষ, উভয় ব্যাক্তির আচরণ দেখেই অনেকে বেশ হাস্য-রসাত্মক কথা বার্তা ও বিরুপ মন্তব্য করতে শুনেছি। তবে আমার মনে হয় তারা নিজেদেরকে বেশ স্মার্ট ও অতিসতর্ক হিসেবেই মনে করেন। তাদের ব্যাপারটা তাদের কাছেই থাক। আমি কিন্তু তাদের কাছ থেকে কয়েকটি বিষয় শিখলাম। তাদের দুই জনের এরুপ ড্রেসআপ দেখে আমার মনে একটি ভাবের উদয় হলো, খুলে গেল জ্ঞানের একটি দুয়ার। আমি তখন অনুভব করলাম ইসলাম কেন পর্দার হুকুমকে ফরজ করেছ। এই দুই জন একটি অদৃশ্য শত্র“ বা করোনা জীবাণু থেকে বাঁচার জন্য, নিজেকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। নিজের সমস্ত দেহকে আবৃত করতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। অতিরিক্ত গরমে আর ঘামের কারণে দেহ সিদ্ধ (!) হয়ে যায় নি; শরীরে কোন এলার্জিও ভীড় করে নি। কিন্তু কি আশ্চর্যের কথা, যখনই কোন মহিলাকে হিজাবের কথা বলা হয়, নিজের শরীরকে পশুরুপ নরখাদকের বদনজর এড়াতে বলা হয়, তখনই এটা তাদের কাছে সেকেলে মনে হয়। অতিরিক্ত গরমে দেহে ঘাম ঝরে যায়, দেহ সিদ্ধ (!) হয়ে যায়; শরীরে এলার্জি দেখা দেয়। মহান আল­াহপাক যিনি আমাদের স্রষ্টা তিনি ভালো করেই জানেন একজন মহিলার প্রকৃত শত্র“ কারা। কোন জীবাণুতে তার ঈমান মারা পড়বে, ইজ্জত হরণ হবে। তিনি ভাল করেই জানেন পর্দা ব্যবস্থা মহিলা-পুরুষ তথা সকলের জন্যই কল্যাণকর যা হাজারো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের সমাজকে বাঁচাবে। যারা বিদ্যুত আবিস্কার করেছেন তারাই বলেছেন যে, পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটি তাঁর পাশাপাশি চলবে কিন্তু মাঝে একটি আবরণ বা পর্দার ব্যাবধান অবশ্যই থাকবে। নইলে দূর্ঘটনার সৃষ্টি হবে, সব কিছু জ্বলে যাবে। মহান আল­াহ তায়ালা পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে বলেছেন যে, পুরুষ-নারী পাশাপাশি চলবে কিন্তু মাঝে পর্দার একটা ব্যবধান থাকবে। এই ব্যবধান বা পর্দা আমাদেরই উপকারের জন্য। আল­াহর এতে লাভও নেই, লোকসানও নেই। সম্মানিত মা-বোনদেরকে মানুষরুপী করোনা থেকে বাঁচানোর জন্য হিজাবের ব্যবস্থা করেছেন। যারা মেয়েদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, ধর্ষণ করে, পশুদের মতো আচরণ করে তাদেরকে খোদ প্রধানমন্ত্রীও মানুষরুপী পশু হিসেবে সাবাস্ত করেছেন। করোনার সময় অনেককেই আমরা দেখছি তারা একটা নয়, দুইটা মাস্ক পরছেন। কেউ কেউ আবার পুরা মাথা আবৃত করে হেড-শিল্ড ব্যবহার করেছেন। কই তখন তো কেই এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন নি যে, মুখ ঢেকে রাখলে দম বন্ধ হয়ে যায়? এটা মানবতা বিরোধী। বরং এটাকে স্মার্ট এবং স্বাস্থ-সচেতন হিসেবেই দেখছেন। কেউ নাক-মুখ না ঢাকলে তাকে নির্বোধ, বোকা মনে করছেন। তাহলে পর্দার ব্যাপারে আমরা কেন বিরুপ মন্তব্য করি। যারা হিজাব পরে তাদের তো কোন অভিযোগ নেই। হিজাবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, আপত্তি তাদের যারা হিজাব পরে না। 
করোনাকালীন সময়েই সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় মুসলিম মহিলাদের বোরকা বা হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিয়ে সংসদে আইনও পাশ করা হয়েছে। অথচ এই শ্রীলঙ্কাতেই জনসম্মুখে মুখে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আজিব নিয়ম! দ্বি-মুখী নীতি! একেই বলে ডবল স্টান্ডার্ড আরকি! পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, ফ্রান্স সহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে বোরকা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। অথচ তারাই দেশে আইন পাশ করেছে যে, পথেঘাটে বের হলে মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক না পরলে জেল জরিমানা হবে। অনেক দেশে তো মাস্ক না পরার কারণে অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে মাস্ক পরতে বাধ্য করা কি নিছক একটি বোকামি, নাকি অহেতুক কাজ? এতে ব্যাক্তি স্বাধীনতায় কোন ব্যাঘাত ঘটে না? এর উত্তরে আইন বিশেষজ্ঞগণ ও স্বাস্থ্য-বিশষেজ্ঞগণ বলবেন, তা কখনই নয়। এই আইন অহেতুকও নয়, আবার ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধেও নয়। দেশের কল্যাণে, জনস্বার্থে এই আইন খুবই জরুরী। তাহলে মহান আল­াহ তায়ালা যিনি সমস্ত রাজ্যের মালিক তিনি যদি জনস্বার্থে হিজাবের বিধান জারী করেন, তাহলে তা কেন সেকেলে হবে অথবা ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিরোধী হবে? জনসম্মুখে মহিলাদের বোরকা পরতে নিষেধ করার পিছনে যুক্তি দেখানো হয় যে, এটা দেশের নিরাপত্তা বিরোধী, সিকিউরিটি কনসার্ন। কারণ, মুখ ঢেকে কেউ সন্ত্রাসী কাজ করতে পারে। তাহলে বুঝা যাবে না যে কে এই আকামটা করল। এই কারণে হিজাব পরা যাবে না। বেশ ভালো কথা!  তাহলে মুখে মাস্ক পরলে, আর ফেস শিল্ড ও হেড শিল্ড ব্যবহার করলে এটা সিকিউরিটি কনসার্ন বা নিরাপত্তা বিরোধী হবে না? কথায় বলে, যাকে দেখতে নারি (না পারি) তার চলন বাঁকা। পশ্চিমা বিশ্বের এটা ইসলামফোবিয়া (ইসলামভীতি) ও ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তারা ব্যাক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে। কিন্তু মুসলমানদের প্রশ্নে তাদের এই সমস্ত বুলি কোথায় উড়ে যায়? পাঠকের কাছেই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের দায়ভার ছেড়ে দিলাম। মাস্ক পড়তে বাধ্য করা আর হিজাব নিষিদ্ধ করা পরস্পর বিরোধী নয় কি? হিজাব ব্যবহার করলে কি মাস্কের শর্ত পূরণ হয় না? মাস্ক যদি একেলে ও স্মার্ট হয়, তাহলে হিজাব কেন সেকেলে হবে? 
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)