খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ পৌষ ১৪৩১

সুখী হবার উপায় পর্ব-১

সারাক্ষণ মন খারাপ লাগে, সব সময় হাসি-খুশি থাকতে চান?

ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা |
০১:০৪ এ.এম | ৩০ জুন ২০২২


আপনি আপনার শরীরের হরমোন নিজেই কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে সুখী হতে পারেন এখনই। একটু বুঝিয়ে বলি। আমাদের শরীর হরমোনের ভারসাম্যের খেলা। এখানে কিছু Happy hormone  আছে যারা মুহূর্তের মধ্যে সুখানুভূতি তৈরি করতে পারেন। পাঁচটি প্রধান হ্যাপি হরমোন হলো ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন।  কীভাবে এই হরমোনগুলো আপনার শরীরে কাজ করতে শুরু করবে?
ডোপামিন : এই হ্যাপী হরমোন হলো এমন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা কাউকে কোনো ভালো কাজের প্রশংসা করলেই বাড়ে। দেখানো প্রশংসা নয়, তেলমর্দন ও নয়। নিখাঁদ মন থেকে তার জন্য ভালো বলুন। সামনে বা পেছনে বলুন। এমনকি যাকে একটুও পছন্দ নয় তারও তো কিছু গুণ রয়েছে সেটাও কিন্তু বলতে পারেন। বিনিময়ে আপনি চরম সুখানুভূতি পাবেন। বিশ্বাস না হয় একটু ট্রাই করে দেখুন।
ডোপামিন বাড়াতে নিজের কাজটাকে ভালোভাবে করার চেষ্টা করুন।  কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হলে নিজেও নিজেকে প্রশংসা করে। এতেও ডোপামিন বাড়ে। দেখবেন যাদেরকে সুখী মনে হয়, তারা মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন বা হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলেন। এসব মানুষের শরীর ডোপামিন এর আধার।
সৃজনশীল বা কল্যাণমূলক কাজেও নিজেকে জড়াতে পারেন। গান শুনা মানুষের মনের ওপর বেশ প্রভাব রাখে। Music Therapy একটা চিকিৎসার নাম। একা একা সুর লাগুক না লাগুক খালি গলায় পছন্দের গানটা গাইতেও পারেন। গান গাওয়া হলে কান তার সংবেদন মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় এবং এতে উষ্ণ বা চনমনে অনুভব হয়। অনেক bathroom singer আছে না? ভেবে দেখুন কি সুখী তারা ঐ সময় !!
সেরোটোনিন : এটি হলো মেজাজ ভালো করার হরমোন। সেরোটোনিন ক্ষরিত হয় তখনি যখন, আমরা নি:স্বার্থভাবে কারো জন্য কিছু করি। আরো আছে। আমার কাছের মানুষেরা জানে ,আমি নিজে এর বৃদ্ধির ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট থাকি। প্রাকৃতিক উপায়ে সেরোটোনিন বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, প্রতিদিন শরীরচর্চা করা। এমনকি ১০ মিনিট দ্রুত হাঁটলেও মেজাজ ভালো হয়ে যেতে পারে। যেটা আমার কখনোই করা হয় না। আমি যেটা করি। খাবার খেয়ে। কি খাই?  
স্বাস্থ্যকর, উচ্চ আঁশের কার্বোহাইড্রেট, কলা খেলে সেরোটোনিন বাড়ে। চকোলেটে আছে ট্রিপ্টোফান যা মস্তিষ্কে সেরোটনিন উৎপাদনে সাহায্য করে যা মন ভালো রাখতে সহায়ক। তবে খেয়াল রাখতে হবে dental cavity I diabetes এর দিকে।
পোষা প্রাণী মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। আপনাকে দেখে তাদের আনন্দ উত্তেজনা, তাদের বিশ্বস্ততা ইত্যাদি আপনাকে ভালো সঙ্গ দেবে। পোশা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটালে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। 
গবেষণায় দেখা গেছে, পোষা কুকুরের সঙ্গে কেবল ১৫ মিনিট সময় কাটালে তা সেরোটনিন ও অক্সিটোসিন দু’টোই হরমোন নিঃসরণ করে যা মানসিক চাপ বৃদ্ধিকারী কর্টিসোল হরমোন কমাতে সহায়তা করে।
হাতে একটু লেবুর পাতা বা তুলসি পাতা বা গাঁদা বেলি ফুল নিয়ে নাকে নিন। মুহূর্তেই একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন।আমি এটা রোজ সকালে করি। সকালে শিশির ভেজা নরম ঘাসে হাঁটা এটা আমরা সবাই পারিনা। এসব সেরোটোনিন রোগ করে আমাদের শরীরে।
অক্সিটোসিন : অক্সিটোসিন কিন্তু ক্ষরিত হয় তখনি, যখন আমরা কোন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করি, জড়িয়ে ধরি বা করমর্দন করি।
আজকাল আমরা ঈদের পরে  হরহামেশাই স্কুল কলেজের পুরনো বন্ধুরা পুনর্মিলনী করি। আসলে আমরা অক্সিটোসিন খুঁজি। এই হ্যাপি হরমোনকে Love Hormone  বলা হয়। 
প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটালে ও অপরের প্রতি সদয় হলে শরীরে অক্সিটোসিন বাড়ে। তাই ব্যস্ততা কমিয়ে পরিবারকে সময় দিন। স্মার্ট ফোন বাদ দিন এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনেও সময় কম ব্যয় করুন। এটি  দ্রুত ও কার্যকর। অন্তরে মানুষের প্রতি ভালোবাসার চর্চাও করতে হবে। সামাজিক ও ডিজিটাল হিংসা একদম নয়।
ইস্ট্রোজেন : এই হ্যাপি হরমোন আরেকটি হ্যাপি হরমোন সেরোটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে এবং খিটখিটে আচরণ ও দুশ্চিন্তা কমিয়ে থাকে। এটা মেজাজে স্থিরতা আনে। 
নারীর মেনোপজ (মাসিক চক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ) হলে ইস্ট্রোজেন কমে যায়। যাদের মেনোপজ হতে যাচ্ছে তাদের ইস্ট্রোজেনও কমতে থাকে। এ কারণে এ সময় নারীদের খিটখিটে আচরণ বেড়ে যায়। 
এছাড়া ধূমপান ও তীব্র শরীরচর্চায় ইস্ট্রোজেন কমতে পারে। শরীরে ইস্ট্রোজেনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে মানসিক চাপ (স্ট্রেস) নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ স্ট্রেস হরমোন করটিসোল হ্যাপি হরমোন ইস্ট্রোজেন ও সেরোটোনিন নিঃসরণে হস্তক্ষেপ করে। হরমোন দু’টির কার্যক্রমও ব্যাহত করে। মানসিক চাপ কমাতে প্রার্থনা, ধ্যান, যোগব্যায়াম ও সামাজিকতায় যুক্ত হতে পারেন।
এন্ডোরফিন : এন্ডরফিন একটি তৃপ্তি দায়ী (ফিল গুড) হরমোন।  শারীরিক কার্যকলাপ যেমন দৌড়, ঘরে বসেই সাইকেল চালানো, যোগ ব্যায়াম, নাচ ইত্যাদি এভাবে শরীরে ঘাম ঝড়ানো বা ২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটা চলা এগুলো Endorphin-এর উৎস।
এতো কিছু পারছেন না? হাসুন। হাসি কেবল ভালো অনুভূতিরই প্রকাশ না বরং গবেষণাতেও দেখা গেছে যে হাসি মন ভালো রাখতেও সহায়তা করে। সাধারণ হাসির অভিনয়, এমনকি জোর করেও যদি হাসির অনুশীলন করা হয় এটাও মস্তিষ্কের সুখী হওয়ার অনুভূতি তৈরি করে ও মন ভালো রাখতে সহায়তা করে।
প্রোজেস্টেরন : এটা ভালোভাবে ঘুমাতে, দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা এড়াতে এবং মেজাজের আগ্রাসী ওঠানামা প্রতিরোধে সহায়তা করে। যেসব নারী মেনোপজের দিকে যাচ্ছেন (সাধারণত ৩৫ বা ৪০ বছরের পর) তাদের শরীরে এই হ্যাপী হরমোন কমতে থাকে। অত্যধিক মানসিক চাপ বা অস্বাস্থ্যকর খাবারে হরমোনটির মাত্রা আরো কমে যায়। 
হরমোন বিশেষজ্ঞদের মতে, পুষ্টিকর খাবার খেলে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও চিনি এড়িয়ে চললে এবং মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কমালে প্রোজেস্টেরন বাড়বে। এরপরও ব্যর্থ হলে হরমোন রিপে¬সমেন্ট থেরাপির প্রয়োজন আছে।
নামাজ ধ্যান এসবগুলো হরমোনের booster dose. দেখবেন অনেক বড় লোক অর্থ প্রতিপত্তির কোন অভাব নেই। তার মনে নাই সুখ। তার অভাব ডোপামিন সেরোটোনিন অক্সিটোসিনের। যাদেরকে আপনার চারপামে সুখি বলে মনে হচ্ছে, এবার তাদের কার্যকলাপগুলো দেখুন সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা আপনার হাতে।
প্রকৃতির এমনই নিয়ম, এই মানবীয় গুণগুলো অর্জন না করলে কখনোই হরমোনগুলোর দেখা পাবেন না, আর কখনোই নিজেকে সুখি অনুভব করতে পারবেন না।  ছোট্ট ছোট্ট কাজ কিন্তু দারুণ সাইন্টিফিক। তাহলে আজ থেকেই শুরু করে দিন, হয়ে যান পৃথিবীর চির সুখীজন। 

লেখক:  মেডিকল অফিসার, সিভিল সার্জন কার্যালয়, খুলনা।