খুলনা | রবিবার | ১৩ জুলাই ২০২৫ | ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

লাব্বাইকে মুখর আরাফাত ময়দান : বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা

হজের খুতবা : উম্মতে মুসলিমদের উচিত পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সদ্ভাব বজায় রাখা

খবর প্রতিবেদন |
১২:২৯ এ.এম | ২০ জুলাই ২০২১

ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে ৬০ হাজার মুসলি­র উপস্থিতিতে খুতবা প্রদানের মাধ্যমে শেষ হলো হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। মহান আল­াহর নৈকট্যের আশায় সোমবার দিনভর ‘লাব্বাইক আল­াহ হুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখর থাকে আরাফাতের ময়দান। সোমবার মুজদালিফায় রাত কাটানোর পর, মঙ্গলবার পশু কোরবানি করবেন হাজিরা।
করোনা মহামারির মধ্যে এটা দ্বিতীয় হজ। তাই সীমিত পরিসরে কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালিত হচ্ছে এবারের হজ। এ বছর হজে খুতবা দিয়েছেন সৌদি আরবের বিশিষ্ট আলেম, মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা। তিনি সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদেরও সদস্য।
পবিত্র অনুভব আর ঐশী আবেগে উদ্ভাসিত ৬০ হাজার মুসলি­র উপস্থিতিতে আরাফাত ময়দান ছিল কাণায় কাণায় পূর্ণ। ইসলামের ইতিহাসে হজ পালনে শুভ্র বসনে অভিন্ন অবস্থানে অগণিত নারী-পুরুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘লাব্বাইক আল­াহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ানিন মাতা লাওয়াকুলমুলক লা শারিকালাক।’
সোমবার সৌদি আরবের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সালাম দিয়ে হজের খুতবা শুরু করেন মসজিদুল হারামের ইমাম ও শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা। খুতবার শুরুতে তিনি মহান আল­াহ তায়ালার প্রশংসা করেন ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ রাসুলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সালামের ওপর দুরুদ পড়েন। এবারের হজে অংশগ্রহণকারী উপস্থিত হাজিদের সুস্থতা চেয়ে দোয়া করেন তিনি।
হজের খুতবায় শায়খ বালিলা মুসলিম উম্মাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, উম্মতে মুসলিমদের উচিত পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সদ্ভাব বজায় রাখা। তোমরা আল­াহকে ভয় করো। নিজের নফসকে হেফাজত করো। আল­াহর ওয়াস্তে তোমার প্রতিশ্র“তি পূরণ করো।
খুতবায় রাসুলের (সাঃ) একটি হাদিস পড়েন, যার মূল কথা হলো-কোনো মুসলমানের যদি সক্ষমতা অর্জন হয়, তাহলে জীবনে একবার হলেও তাকে অবশ্যই হজ করতে হবে।
শায়খ ড. বান্দার বালিলা বলেন, আল­াহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আমি ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং কাউকে শরিক মানবে না। নবীজি (সাঃ) বর্ণনা করেছেন, তোমরা পৃথিবীতে বসবাসকারীদের ওপর দয়া করো, আল­াহ তায়ালা তোমাদের ওপর দয়া করবেন। মুসলমানদের উচিত পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য ও সদ্ভাব বজায় রাখা।
খতিব বলেন, উম্মতের পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও স¤প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। আল­াহর রহমত থেকে সেই ব্যক্তিই নিরাশ হয় যে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। দয়াময় আল­াহ তায়ালা বলেছেন, আমার রহমত আমার আজাবের ওপর প্রাধান্য পায়। নবীজি (সাঃ) বলেছেন, জান্নাতে আল­াহর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
শায়খ বালিলা আরও বলেন, হে মানব স¤প্রদায়, আল­াহ তায়ালা তোমাদের ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে মানবজাতির জন্য এমন বিধিবিধান রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে সমশ্রেণির মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ইনসাফ ও ন্যায়বিচার ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এটি ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। আমাদের আচার-আচরণ ও ব্যবহারে এ বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে হবে। আল­াহ তায়ালা যেভাবে তোমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও অন্যের ওপর অনুগ্রহ করো। আল­াহ তায়ালার রহমত অনুগ্রহকারীদের নিকটবর্তী থাকে সব সময়। আল­াহ তায়ালা পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল­াহ তায়ালার নির্দেশ হলো পিতা-মাতার পরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভালো আচরণ করো। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, নিজের অধীনস্থদের সঙ্গে ভালো আচরণ করো। নিজের অধীনস্থ চাকর-বাকরদের তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে ওপরে বোঝা চাপিয়ে দেবে না। অন্যকে দেওয়া প্রতিশ্র“তি পুরো করারও নির্দেশনা দিয়েছেন আল­াহ।
খুতবায় শায়খ বান্দার বিন বালিলা বলেন, আল­াহ তায়ালা বলেছেন, তোমার জন্য কুরআনকে নাজিল করা হয়েছে, যেন তুমি হেদায়েত পাও। আর আল­াহ যাকে চান, তাকে হেদায়েত দেন। নিজের আত্মশুদ্ধি করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো। নিজের রবের ইবাদত এমনভাবে করো যেন তিনি তোমাকে দেখছেন।
কাবার ইমাম খুতবায় বলেন, আল­াহ তায়ালা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, আল­াহ তায়ালার রজ্জুকে শক্তভাবে ধরো, মতপার্থক্যে যেও না। পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সম্পর্ক তৈরি করো। বিদ্বেষ ও শত্র“তা খতম করো। পৃথিবীতে ভারসাম্যতা তৈরি করো। আল­াহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ক্ষমা করো।
কাবার ইমাম বলেন, তোমরা আল­াহকে ভয় করো এবং তোমরা নামাজ আদায় করো। নিজের মনকে হেফাজত করো। আল­াহর ওয়াস্তে তোমার প্রতিশ্র“তি পূরণ করো। আল­াহ বললেন, শয়তান আপনাকে বিপথগামী করার চেষ্টা করবে। রাসুলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেছেন, আল­াহর রহমত ও অনুগ্রহ ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
শায়খ বান্দার বিন বালিলা বলেন, যে ফজিলত হলো আপনি আল­াহর ইবাদত করেন যেন আপনি তাকে দেখছেন। যদি এটি সম্ভব না হয় তবে ভাববেন যে তিনি আপনাকে দেখছেন। আল­াহ বলেন, কোনো বান্দা যদি নিজের ওপর অন্যায় করে তবে তার জন্য তওবা করার দরজা উন্মুক্ত রয়েছে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যদি কোনো এলাকায় কোনও রোগ ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তবে সেখানে যাবেন না।
হজের খুতবায় আরো বলা হয়, অহঙ্কারীদের আল­াহ পছন্দ করেন না। আল­াহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করেন। আল­াহ বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। তোমরা আল­াহর ইবাদত করো, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, মহানবী হলেন সর্বশেষ নবী। তোমরা তোমাদের নামাজ সংরক্ষণ করো, নামাজের ব্যপারে যতœবান হও। আল­াহ পরাক্রমশালী, তাকে ভয় করুন এবং তাকওয়া অবলম্বন করুন। নিশ্চয় আল­াহ তায়ালা সব মানুষের সঙ্গেই রয়েছেন। আল­াহ তায়ালা কারো আমলকে বিনষ্ট করেন না। তিনি বলেন, হে মানব স¤প্রদায়, নবীজি (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের কোনো এলাকায় যদি মহামারি দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না এবং সেখানে প্রবেশ করো না।
২৫ মিনিট ব্যাপী খুতবার শেষাংশে সৌদি সরকারের জন্য দোয়া করেন ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা। সেই সঙ্গে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করেন। করোনাকে মহামারি উলে­খ করে এর থেকে বিশ্ববাসীর হেফাজতের জন্য দোয়া করেন। সর্বাবস্থায় আল­াহর দরবারে যাবতীয় সমস্যার জন্য বেশি বেশি দোয়া করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
খুতবা শেষে জোহরের নামাজের আজান দেওয়া হয়। এরপর খতিব উপস্থিত হাজিদের নিয়ে দুই ইকামতে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন।
গত বছরের মতো এ বছরও পবিত্র হজের আরবি খুতবা অন্যান্য খুতবার পাশাপাশি দ্বিতীয় বারের মতো বাংলা ভাষায়ও অনুবাদ করে স¤প্রচার করা হয়েছে। বাংলা ভাষা ছাড়াও বাকি নয়টি ভাষা হলো ইংরেজি, মালয়, উর্দু, ফার্সি, ফ্রেঞ্চ, মান্দারিন, তুর্কি, রুশ ও হাবসি। ২০১৯ সালের পবিত্র হজে পাঁচ ভাষায় হজের খুতবার অনুবাদ প্রচারিত হয়েছিল।
আরাফাতের ময়দানে সমবেত মুসলি­রা এক লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের মসজিদে নামিরায় আদায় করেন জোহর ও আসরের নামাজ। পরে তারা পা বাড়ান প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফার পথে। মাগরিব ও এশার নামাজ সেখানে পড়বেন তারা। সেখানেই রাতে খোলা আকাশের নিচে থাকবেন। এটি ওয়াজিব। ১০ জিলহজ মঙ্গলবার হাজিরা মাথা মুণ্ডন ও পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করবেন হজ।
হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বছরের ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা অনুষ্ঠিত হয়। এই আরাফাতের ময়দানেই হযরত মুহাম্মদ রাসুলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
বছর জুড়ে কালো গিলাফ বা কিসওয়ায় আবৃত থাকে পবিত্র কাবা শরিফ। প্রতি বছর হজের দিন ৯ জিলহজ ফজরের নামাজের পর পরই পরানো হয় নতুন গিলাফ।
৯ জিলহজ সোমবার ফজরের নামাজের পর হজযাত্রীরা আরাফাত ময়দানে চলে গেলে গিলাফ পরিবর্তনের কথা থাকলেও রীতি ভেঙে রবিবার রাতে পুরনো গিলাফ বদলে নতুন গিলাফ চড়ানোর কাজ শুরু হয়। হারামাইন শরাফাইনের সভাপতির তত্ত¡াবধানে গিলাফ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শেষে করেন এ কাজে নিয়োজিত বিশেষ কর্মীরা। এদিকে গিলাফ পরিবর্তনের কাজে অংশ নিয়েছে সৌদির প্রভাবশালী অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান।