খুলনা | বুধবার | ১৪ মে ২০২৫ | ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

আখেরি চাহার শোম্বাঃ হাদিসে তার ভিত্তি কোথায়? (পর্ব-২)

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০৩:০৭ এ.এম | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২


‘আখেরি চাহার শোম্বা’ অর্থ হলো ‘শেষ বুধবার’। উদ্দেশ্য হলো আরবী সফর মাসের শেষ বুধবার। আমাদের সমাজের কিছু মানুষ অজ্ঞতাবশত হিজরি সফর মাসের শেষ বুধবারকে ইসলামী দিবস হিসেবে পালন করেন। এমনকি এ দিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। এ বছরে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার দেশে আখেরি চাহার শোম্বা উদযাপিত হবে। কিন্তু কুরআন-হাদিসে এর কি কোন ভিত্তি আছে?
আখেরি চাহার শোম্বা ভিত্তিহীন হওয়ার প্রমাণ:
আখেরি চাহার শোম্বার সকল অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম যে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তার প্রমাণ হলো, হাদিসে বা সীরাতে এর কোন অস্তিত্ব নেই। তাছাড়া এ দিবস নিয়ে যা বলা হয় তা সহীহ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং যুক্তিবিরোধী। 

উদাহরণ স্বরূপ; 
এক. দিবস পালনকারীরা দাবি করেন, হুজুর (সাঃ) দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন এবং সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন ও গোসল করেন। এটাই হুজুরের জীবনের শেষ গোসল ছিল। অর্থাৎ এর কয়েক দিন পরেই তিনি মারা যান। এটা প্রসিদ্ধ যে, মহানবী (সাঃ) ৯ অথবা ১২ ই রবিউল আউয়াল সোমবার ইন্তেকাল করেন। আর সোমবার যদি বারো-ই রবিউল আউয়াল হয়ে থাকে তাহলে এর আগের বুধবার তো সফর নয়, রবিউল আউয়ালই হচ্ছে। কোথায় সফর কোথায় রবিউল আউয়াল? সুতরাং এটা কোনভাবেই মিলানো সম্ভব নয়। 
দুই. রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা সত্য যা প্রায় সমস্ত হাদিসের কিতাবে উল্লেখ আছে। কিন্তু হুজুর (সাঃ) এর সুস্থতা ও গোসল নিয়ে আখেরি চাহার শোম্বার ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা সবই ভিত্তিহীন। নির্ভরযোগ্য সিরাতের কিতাব থেকে জানা যায়, জাদুর ঘটনা ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এ জাদুর প্রভাব কতদিন ছিল সে সম্পর্কে দু’টি বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় ছয় মাস ও অন্য বর্ণনায় এসেছে চল্লিশ দিনের কথা। কিন্তু এ দুই বিবরণে কোনো সংঘর্ষ নেই। এক বর্ণনায় পুরো সময়ের কথা এসেছে, আর অপর বর্ণনায় এসেছে শুধু ওই সময়টুকুর কথা যাতে জাদুর প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল। তবে অসুস্থতার মেয়াদ যাই হোক না কেন, সুস্থতার তারিখ কোনো হিসাব মতেই সফরের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার শোম্বা হতে পারে না। হাদীস বিশারদ ও ইতিহাসবিদ কারো মতেই সুস্থতার তারিখ সফরের শেষ বুধবার বা আখেরী চাহার শোম্বা ছিল না।
তিন. নবীজির (সাঃ) উপর জাদুর ঘটনা হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু সেখানে কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই যে, সে সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম মসজিদে জামাআতে শরীক হতে পারেননি অথবা জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর গোসল করেছেন। 
চার. তাছাড়া এ তথ্যও সঠিক নয় যে, বুধবারের পর রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম আর কোন গোসল করার সুযোগ পাননি। কারণ, এরপর এক রাত ইশার নামাযের আগে গোসল করার কথা প্রায় সকল সহীহ হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে (বুখারী, মুসলিম)।  
পাঁচ. একথার কোন প্রমাণ নেই যে, বুধবারের পর অসুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। সহীহ হাদীস গ্রন্থে এ কথা বর্ণিত আছে যে, এরপর নবীজি (সাঃ) আরেক দিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাযে শরীক হয়েছিলেন (বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়া সিরাতের নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে জানা যায়, মহানবী (সাঃ) সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন, যার কারণে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হুজুরের অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। 
ছয়.  রাসুলে কারীম (সাঃ) এর উপর অনেকবারই প্রচন্ড বিপদ ও মুসিবত এসেছিল। আল্লাহ তা’আলা তাকে নাজাতও দিয়েছেন। যেমন, তায়েফ ও ওহুদে তিনি প্রচন্ডভাবে আহত হয়েছিলেন। শরীর রক্তাক্ত হয়েছে।  আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সুস্থ করেছেন। বদরের যুদ্ধে হাজারো কাফেরের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে বিজয় দান করেছেন। ইয়াহুদিরা ষড়যন্ত্র করে উপর থেকে পাথর চাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলার গোপন পরিকল্পনা করেছে। আল্লাহ তা’আলা তা থেকে নাজাত দিয়েছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি। এমতাবস্থায়, মহান আল্লাহপাক তাকে সুস্থ করেছেন। অসুস্থতার এরূপ আরও অনেক ঘটনা আছে; কিন্তু নবী (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে তা দিবস হিসেবে স্মরণ রাখার জন্য কোন আমল করার কথা বলেননি। 
মহানবীর (সাঃ) সুস্থতার কারণে আনন্দিত হওয়া কিংবা তার সুস্থতার সংবাদ জেনে খুশি হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একথা দাবি করা যে, সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের তাবেয়ী, তাবেয়ীগণ সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন, এটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এ দাবির স্বপক্ষে কুরআন, হাদিস বা সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকে কোন দলিল পাওয়া যায় না।  তাঁর সুস্থতা লাভের এই সব আনন্দের স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য দিবস উদযাপনের যেখানে কোনো নিয়ম ইসলামে রাখা হয়নি, সেখানে আখেরি চাহার শোম্বা, যার কোনো ভিত্তিই নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?
মোদ্দা কথা এই যে, রাসুলে কারীম (সাঃ) এর প্রতি মহব্বত, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকা ভালো। তবে তা হতে হবে, কুরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পদ্ধতি অনুসারে। তা না হলে এ ধরণের মহব্বতের কোন মূল্য নেই। কোনো বিশেষ দিনকে বিশেষ ফযীলতের দিবস মনে করে উৎযাপন করা, কিংবা বিশেষ কোনো আমল তাতে বিধিবদ্ধ করা, এগুলো সবই ইসলামী বিধান বা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এগুলো কুরআন-হাদিসের দলিল ছাড়া শুধুমাত্র মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় না। এটা একটি অকাট্য মূলনীতি। এ সব কারণে এ দিবসকে ঘিরে আখেরি চাহার শোম্বার নামে যেসব রসম-রেওয়াজ চালু আছে তা কোন মতেই সমীচিন নয়। সাহাবায়ে কেরামের যুগের হাজার হাজার বছর পর নতুন উদ্ভাবিত এই রসম ও রেওয়াজের কোন ভিত্তি নেই। তাই আসুন, আমরা সকল ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজ পরিহার করে কুরআন, হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পথে চলে জীবনকে আলোকিত করি। 
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।)