খুলনা | শনিবার | ২৪ মে ২০২৫ | ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আসল কারণ ও প্রতিকার

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০২:২৭ এ.এম | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২


প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে এখন একটি আলোচ্য বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব যে সারা পৃথিবীতে পড়ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শীতের সময় পড়ছে গরম। বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই; অসময়ে হচ্ছে বৃষ্টি।  কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি আসলেই প্রাকৃতিক? অর্থাৎ, কাকতালীয় প্রাকৃতিক? খামাখা হচ্ছে? নাকি এর পিছনে কেউ কাজ করছে? তার কারণ আছে?
আসমান-জমিন, আকাশ-বাতাস, নভোমন্ডল-ভ‚মন্ডলে যা কিছু আছে; আমরা দেখি বা না দেখি, আন্দাজ করতে পারি বা না পারি; সবই মহান  আল­াহতায়ালার মাখলুক বা সৃষ্টি। অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির ওপরেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সবই আল­াহ’র সৈন্য বাহিনী। আল­াহপাকই ভালো জানেন কখন কোন সৈন্য কার বিরুদ্ধে লাগাবেন। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। বাতাস ও পানি আমাদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় দু’টি বস্তু; কিন্তু এই বাতাস, পানি ও ঝড়-ঝঞ্জা দিয়েই আল­াহতায়ালা আদ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। নুহ (আঃ)-এর জাতিকে আল­াহতায়ালা বন্যা-তুফান দিয়ে নাস্তা-নাবুদ করে দিয়েছিলেন। সমকামিতার কারণে লুত (আঃ)-এর জাতিকে একইভাবে মহাদুর্যোগ দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (বিস্তারিত দেখুন সূরা ক্বমার: ৯-২১, সূরা ফুচ্ছিলাত: ১৫, সূরা আহক্বফ: ২০-২৫, সূরা নামল: ৫৪-৫৮)  
প্রাকৃতিক দুর্যোগের শুধুমাত্র বাহ্যিক কারণ গুলো আমরা দেখি; যেগুলো মূলত কারণ নয়, কারণের ফলাফল প্রকাশের মাধ্যম। এর মূল কারণ তাহলে কি? বিষয়টির একটি উপমা দিলে বুঝতে সহজ হবে। মানুষের বাড়ির মালিক ছাদের ওপর থেকে একটি অবাধ্য ও পাগলা কুকুুরকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে মারলো। উদ্দেশ্য কুকুরটাকে কিছুটা সায়েস্তা করা। ঢিলটি কুকুরের গায়ে লেগে দূরে ছিটকে পড়লো। এতে অবোধ কুকুরটি মনে করলো, এই ঢিলটিই তাকে আঘাত করেছে। এইজন্য সে ঢিলটির দিকে দ্রুত ছুটে গিয়ে সেটাকে উপর্যুপরি কামড়াতে শুরু করলো। সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হলো, কুকুরের মাথায় এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, সে বুঝতে পারবে, ঢিল তাকে আঘাত করেনি; বরং আঘাত করেছে তার মালিক। আমাদের ব্যাপারও অনেকটা অনুরূপ। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলেই তার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, ঝড়-ঝাপটা, হারিকেন-সাইক্লোনই আমাদের আঘাত করেছে। কিন্তু এটা আমরা অনুধাবন করতে পারি না যে, যা এসেছে সবকিছু মহান পরাক্রমশালী আল­া’র প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষ হুকুম, আদেশ বা ইশারাতে হয়েছে। আর এটা আন্দাজ করা মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। এই কারণেই আল­াহতায়ালা সৃষ্টি-রহস্যের নিঁখুত জ্ঞান দিয়ে নবী-রসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। কোরআন ও হাদিসের অগাধ জ্ঞানভান্ডার থেকে জানা যায়, আসমান ও জমিনে যা কিছু বিপর্যয় ঘটে তা মানুষের দুই হাতের কামাই। অর্থাৎ আমরা যেমন কর্ম করবো তেমন ফল পাবো। সাধারণত কয়েকটি কারণে আল­াহপাক আজাব বা বিপর্যয় পাঠান। অবাধ্যকে শাস্তি দেবার জন্য, গোনাহগারদের সতর্ক করার জন্য, মুমিনের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য অথবা মুমিদেরকে পরীক্ষার জন্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল­াহপাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: তোমাদের ওপর যে বিপদ-আপদ পতিত হয় তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন (সূরা শু’রা: ৩০)। জলে-স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল­াহ তাদেরকে কৃতকর্মের (কিছুটা) শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে (সূরা রুম: ৪১)। কখনও কখনও মুমিন বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মহান আল­াহতায়ালা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে আল­াহপাক বলেন: অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছুটা, ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষয়-ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে তাদের সুসংবাদ দাও যারা ধৈর্য্য ধারণ করবে। যখন তারা বিপদে পড়ে তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল­া’র জন্য এবং আল­া’র কাছেই ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল­া’র অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত (সূরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)। 
মোট কথা, আমাদের নানাবিধ খারাপ আমলের কারণে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় দেখা যায়। একটি হাদিসে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রসূলুল­াহ (সঃ) এরশাদ করেছেন: যখন মানুষ গণীমতের মালকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করতে আরম্ভ করবে, আমানতকে (জনগণের মাল, সরকারি সম্পত্তিও এর মধ্যে শামিল) গণীমতের মাল মনে করতে শুরু করবে (অর্থাৎ আমানতকে আদায় করার পরিবর্তে নিজে খরচ করে ফেলবে), যাকাতকে জরিমানা মনে করতে আরম্ভ করবে (অর্থাৎ খুশি মনে দেবার পরিবর্তে অসন্তুষ্টির সাথে দিবে), এলেম দ্বীনের উদ্দেশ্যে নয় বরং দুনিয়ার জন্য অর্জন করতে শুরু করবে, মানুষ স্ত্রীর আনুগত্য করবে ও মায়ের অবাধ্যতা করতে শুরু করবে, বন্ধু-বান্ধবকে  নিকটে করবে ও বাপকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদের মধ্যে প্রকাশ্যে শোরগোল করা আরম্ভ হবে, ফাসেক বা গোনাহগার লোক জাতির নেতৃত্ব দিতে শুরু করবে, জাতির নেতারা জাতির নিকৃষ্টতম লোক হবে, কারও অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তার সম্মান করবে, গায়িকা নারীদের এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন হবে, ব্যাপকভাবে শরাব (মদ বা নেশা জাতীয় পানীয় ইত্যাদি) পান করা হবে এবং উম্মতের পরবর্তি লোকেরা তাদের পূর্ববর্তি লোকদেরকে মন্দ বলা শুরু করবে, এমন সময় অপেক্ষা করো লালবর্ণের ঝড়, ভ‚মিকম্প, ভ‚মি ধ্বস, মানুষের চেহারা বিকৃতি হওয়া এবং আকাশ থেকে পাথর (বা পাথরের মতো বৃষ্টি) বর্ষিত হওয়ার। আর এমন বিপদ আপদের জন্য অপেক্ষা করো, যেমন মালার সুতা ছিঁড়ে গেলে তার মুক্তাদানা গুলো একের পর এক দ্রুত পড়তে থাকে (তিরমিজি)। আমরা বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে বুঝতে পারব যে, সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারী গুলো ঠিক যেন এই হাদিসেরই প্রতিফলন।
আল­াহপাক তার পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন: তারা যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল­াহ কখনও তাদের ওপর আজাব দিবেন না (সূরা আনফাল: ৩৩)। এই কারণে সমস্ত প্রকার মহামারী ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য আমাদের উচিত, গোনাহ থেকে বাঁচা, আল­াহর কাছে মাফ চাওয়া এবং আমাদের আমল বা কর্ম সংশোধন করা। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখনই ঘূর্ণিঝড় বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিত, তখন সাথে সাথেই মহানবী (সঃ) মসজিদে যেতেন এবং  নামাজে মনোনিবেশ করতেন। তওবা-এস্তেগফার, নামাজ-রোযা, দান-সদকা, দোয়া, ধৈর্য্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের উত্তরণ করাই কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা। 
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)