খুলনা | শনিবার | ০৪ অক্টোবর ২০২৫ | ১৮ আশ্বিন ১৪৩২

শিশুর বদ মেজাজ এবং তার কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০১:১৫ এ.এম | ১৩ জুন ২০২১

কেস স্ট্যাডি- (১) ছোয়া, বয়স- ৪ বছর। মায়ের সাথে সে এক বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ঐ বাড়িতে তিন বছেেরর এক মেয়ের সাথে বেশ কিছু খেলনা নিয়ে খেলতে বসে গেছে। একটু পরেই পাশের কক্ষ থেকে মা চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলেন। দৌঁড়ে গিয়ে মা দেখলেন, বাচ্চা দু’টি খেলনা নিয়ে মারামারি করছে। রাগে আপনি আপনার বাচ্চার গায়ে হাত তুললেন। আপনারা একে একে নিজেদের বাচ্চাকে দোষারোপ করতে লাগলেন। বাচ্চাদের কান্না আরও বেড়ে গেল। তবু ও আপনার বাচ্চা তার খেলনাকে দিতে একাবারেই নারাজ। নিতান্তই নিরুপায় হয়ে আপনি হত-বিহŸল হয়ে বসে রইলেন।
কেস স্ট্যাডি- (২) প্রিয়া,বয়স- ৪ বছর। আপনারা সপরিবারে একটি দাওয়াতে যাবেন। বাচ্চাটি যে জামা পরতে আগ্রহি আপনি সেটি পরাতে একে বারেই নারাজ। কিন্তু বাচ্চাটিও জেদি। যে ভাবে হোক সে ঐ জামাটি পরবেই। কোনক্রমেই আপনি হার মানতে নারাজ। জামাটি পরতে না পেরে এবার বাচ্চাটি জোরে কান্নার সঙ্গে বিভিন্ন জিনিসও ভাঙতে শুরু করে দিল। আপনি ও বাচ্চাটিকে এক হাত দেখিয়ে দিলেন। শেষ মেষ পরিস্থিতি এমন যে দাওয়াতটি বর্জন করতে আপনি বাধ্য হলেন। এ প্রকার অসংখ্য ঘটনা প্রতি নিয়ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘটতে থাকে। শিশুর এরুপ মেজাজকে বদমেজাজ বা টেম্পার ট্যান্ট্রম বলে।
শিশুর বদ মেজাজের কারণ : 

(১) মস্তিষ্ক জনীত কারণ : আমাদের বিচার-বিবেচনা, যুক্তি দিয়ে কোন কিছু বোঝার কাজটি করে থাকে মস্তিষ্কের ফ্রি ফ্রন্টাল লোব। এই অংশটি ব্রেনের অন্যান্য অংশের তুলনায় দেরিতে বিকাশ লাভ করে। সাধারণত : এটি চার বছর পর হতে পূরিপূর্ণতা লাভ করতে শুরু করে। ঠিক এ কারণে চার বছরের পূর্বে শিশুর মধ্যে যুক্তি দ্বারা কাজ করার ক্ষমতা খুব বেশি দেখা পাওয়া যায় না। সে কারণে এ বয়সে তারা বিভিন্ন কাজে বাধা পেলে যুক্তির পরিবর্তে আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং বদ মেজাজ প্রদর্শন করে। 

(২) বিশ^াস বনাম অবিশ^াস : শিশুরা যখন ছোট থাকে, তখন তাদের মধ্যে এক প্রকার বিশ^াস সৃষ্টি হয় যে, বড়রা বিশেষ করে মা-বাবা তাকে আদর করবে, পুষ্টি দেবে, তার চাহিদা মেটাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে শিশু যখন বড় হয় তখন দেখে শিশুর সব চাহিদা পূরণ হবার আশা থাকলে ও তাহা হচ্ছে না। এরুপ পরিস্থিতিতে শিশু নিজেকে অসহায় মনে করে এবং সে তার খামখেয়ালী আচরণ প্রদর্শন করে। 

(৩) মানসিক জ¦ালা ও উত্তেজনা : শিশু যখন দেখে বড়রা তাকে বুঝতে চায় না বা শিশু যা বলতে চায় বড়রা তার কথা শোনে না, তখন সে আগ্রাসী হয়ে উঠে এবং বদ মেজাজ প্রদর্শন করে। 

(৪) শারীরিক অসুস্থতা : শিশুর মধ্যে যদি কোন শারীরিক অসুস্থতা ( যেমন : পেটে ব্যথা, কানে ব্যথা বা অন্য কোন শারীরিক ব্যাধী) থেকে থাকে, তবে সে খামখেয়ালী মেজাজ দেখাতে পারে। 

(৫) দুর্বলতা ও নিদ্রাহীনতা : শিশু যদি শারীরিক ভাবে দুর্বল হয় বা রাতে যদি পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব দেখা দেয় তবে সে বদ মেজাজী হয়ে উঠতে পারে। 

(৬) সব কাজে চাপ প্রয়োগ : শিশু যা করতে চায় না, এমন প্রতিটি কাজে যদি তাকে শক্তি প্রয়োগ করে করানো হয়, তবে সে মেজাজ দেখাতে পারে।

বদ মেজাজী শিশুর ব্যবস্থাপনা : 

(১) রুটিন মেনে চলুন : প্রতিদিন শিশুর খাওয়ানো, ঘুম, বিশ্রাম ও খেলার একটি রুটিন তৈরী করুন। রুটিন অনুযায়ী দিনের প্রতিটি কাজ সমাধান হলে বাচ্চার মেজাজ ঠিক থাকে। 

(২) ব্যস্ত রাখুন এবং সময় দিন : শিশুর হাতের নাগালে বিভিন্ন খেলনা, বই দিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। তাহা ছাড়া শিশুকে সময় দেওয়ার সুযোগ তৈরী করুন। বাসায় শিশুর খাবার উপযোগী কিছু ফল, স্ন্যাক রেড়ি রাখুন যাতে সময় মত তাকে দিতে পারেন। 

(৩) নিষেধাজ্ঞার কারণ সমূহ দূূর করুন : ‘এটা ধরো না’, ’ওখানে যেও না’, ’ওটা করো না’- এরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে বাচ্চার জন্য বিভ্রান্তিকর ও বিপদজনক জিনিস তার হাতের নাগাল হতে দূরে রাখুন। ঘরটাকে এমন ভাবে সাজান, যাতে বাচ্চা সহজে ঘরের মধ্যে ঘুরতে পারে। 

(৪) স্বাধীন ভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন : খাবার পূর্বে বাচ্চার নিকট জানতে চান, কোনটা তার আজ পছন্দ। অনেক গুলো নয় বরং সিম্পিল অপসন দিন। এটা না ওটা-এই দু’টা জামার মধ্যে কোনটি তোমার পছন্দ? এভাবে সিম্পল অপসনের মধ্যে তার পছন্দের গুরুত্ব দিন। এতে বাচ্চারা মনে করবে তার স্বাধীনতা আছে এবং বাচ্চার আত্মবিশ^াস বাড়বে। 

(৫) হ্যাঁ/না বলুন, হয়তো/হতে পারে নয় : অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর উত্তর থেকে বিরত থাকুন। স্পষ্ট উত্তর দিন। স্পষ্ট উত্তর দিলে- এতে বাচ্চারা আপনার প্রত্যাশা সহজে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। কখনো কোন ব্যাপারে না বললে- তাহা যেন হ্যাঁ না হয়। 

(৬) শিশুর প্রতি ইতিবাচক মনোযোগ পোষণ করুন : শিশুর ইতিবাচক আচরণের জন্য তাকে প্রশংসা করুন।

জেদি বাচ্চাকে সামলোর আরো কিছু কৌশল : 

(১) বাচ্চা রেগে যাচ্ছে এমন মনে হলে ,তাকে হাসানোর চেষ্টা করুন। তবে অনেক সময় অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রে হাসানোর চেষ্টা করলে তার রাগ আরও বেড়ে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে অন্য পন্থা অবলম্বন করুন। (২) আপনার সোনামনির যখন রাগ হবে তখন উল্টো তাকে রাগ দেখাবেন না। বরং নরম স্বরে কথা বলুন, হেসে দিন বা কোলে তুলে নিন। (৩) শিশুর রাগ যদি এমন পর্যায়ে থাকে যে তাহা ক্ষতিকারক নয়, তবে তাহা মনোযোগে না নিয়ে বরং এড়িয়ে চলুন। (৪) বাইরে কোথাও গেলে যদি আপনার শিশু খুব রাগ দেখায় তবে আপনি উত্তেজিত না হয়ে তার সাথে শান্ত ভাষায় কথা বলুন। (৫) যদি আপনার বাচ্চা অতিথির সামনে বা অন্য কোন সময়ে রাগ করে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে, তবে তাকে অন্য ঘরে নিয়ে যান এবং কিছু সময় সেখানে রাখুন, দেখবেন আস্তে আস্তে তার রাগ পড়ে যাবে। (৬) কখনো আপনার চার বছরের নিচের বাচ্চাকে শারীরিক শাস্তি দিবেন না।
(লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ ,খুলনা।)