খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০৩ জুলাই ২০২৫ | ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

ডলার সংকটের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে

খবর প্রতিবেদন |
০১:২৭ এ.এম | ২২ জানুয়ারী ২০২৩


বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের পরও দেশের বাজারে ডলারের সংকট কাটছে না। সংকট আরও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর প্রভাবে সৃষ্টি আর্থিক খাতের অস্থিরতা অন্য খাতেও ছড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যেই ডলার সংকটের প্রভাব এবারের হজ পালনকারীদের উপর পড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। এ ছাড়া ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চিনি ও ভোজ্যতেল বোঝাই জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি বলেই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। 
ওদিকে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এসব পণ্য আমদানি বন্ধ হলে বা কমে গেলে দাম বৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের উৎপাদনও বন্ধের উপক্রম হবে। এসব কিছুর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তাদের উপর। এমনিতেই আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকায় নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবারে। 
এদিকে ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগের পেমেন্ট না দেয়ায় কয়লা আমদানির এলসি খুলছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চায়না সহযোগী সিএমসি। আবার জাহাজ ভাড়া পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা খালাস আটকে আছে। এতে খেসারত দিতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার ডলার। 
এদিকে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। সে সময় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়। বর্তমানে আরও বেড়ে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এজন্য মাসে বিল দিতে হয় প্রায় ৫২.৬৫ মিলিয়ন ডলার। তবে ডলার সংকটে এ বিল পরিশোধে সংকট দেখা দিয়েছে। 
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্র, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ৩টি জাহাজের চিনি ও ভোজ্যতেল খালাস করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে আসা জাহাজে প্রায় ১২ হাজার টন পাম তেল রয়েছে। ব্রাজিল থেকে আসা জাহাজে ৬০ হাজার ৫০০ টন চিনি রয়েছে। আরও একটি ব্রাজিল থেকে আসা জাহাজে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল রয়েছে প্রায় ৫ হাজার টন। এর মধ্যে কিছুটা খালাস করা গেলেও বাকিটা আটকে আছে। তবে খালাস করতে না পারায় প্রতিদিন জরিমানা গুণতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। 
আমদানিকারকরা জানায়, ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি। তাই জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি হচ্ছে না। তারা জানান, আগামী মার্চ মাসে রমজানে তেল, চিনি, ডালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়বে। তখন আমদানি করতে না পারলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অপরিশোধিত চিনির ঋণপত্র খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ঋণপত্র ৪৭, সয়াবিনবীজ ৮৩, ছোলা ৪৭ ও খেজুর আমদানির ঋণপত্র ৩০ শতাংশ কমেছে। 
পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানিতে কড়াকড়ি করার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট সমাধান করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এ ছাড়া এলসি খুলতে বিদেশি ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এজন্য ডলার সংকট দ্রুত সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যেই জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে ২৬৯.৫৩ মিলিয়ন ডলার চেয়ে দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে।
গত সপ্তাহে দেয়া চিঠিতে এই ১১টি প্রতিষ্ঠান ডলারের চাহিদার বিস্তারিত তুলে ধরেছে। জানা গেছে, রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। সূত্রমতে, ডলার সংকট কাটাতে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফলে কমতে শুরু করে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। সেই হিসেবে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের উপর চাপ কমার কথা। কিন্তু কাঙ্খিত স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি ডলারের বাজার, বরং আগের চেয়ে আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পণ্য আমদানির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ২৬.৫০ শতাংশ। তবে চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। 
এদিকে স¤প্রতি হজ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেন, গত বছর হজে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যান ৫৬ হাজার ৯৫২ জন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজ-১-এর খরচ হয়েছিল জনপ্রতি ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ টাকা এবং প্যাকেজ-২-এ খরচ হয় জনপ্রতি ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। সেই হিসেবে ডলার সংকটের প্রভাব পড়বে এবারের হজে। গত বছরের তুলনায় এবার ব্যয়ও বাড়বে হজযাত্রায়। 
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ২৪৮ মিলিয়ন ডলার চায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেনি। এতে ১১ সংস্থার ২৬৮.৫৩৮ ডলার পরিশোধ আটকে আছে। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে ৩টি বিলে ১২৬.৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে ৫টি বিলে ৪.২৬৩ মিলিয়ন ডলার রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের চাহিদার মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের চাল আমদানিতে ১২.২৫৪ মিলিয়ন ডলার, বিপিসি’র জ্বালানি তেল আমদানিতে ২৯.৪৭৩ মিলিয়ন ডলার, সার আমদানিতে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) ৩টি বিলে ২.২৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) ৩টি বিলে ২.০৩৭ মিলিয়ন ডলার, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে ৩টি বিলে ১২৬.৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে ৫টি বিলে ৪.২৬৩ মিলিয়ন ডলার, টিসিবি’র ছোলা আমদানিতে ৩টি বিলে ১.৩৬২ মিলিয়ন ডলার, পিডিবি’র (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩টি বিলে ১১.০৯৬ মিলিয়ন ডলার, ইস্টার্ন রিফাইনারি ৪.৩০ মিলিয়ন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৭ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। এর বাইরে আরও ৬৫.৯৬৪ মিলিয়ন ডলার ও ২.৬৮ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল সোনালী ব্যাংক। সূত্র মতে, সোনালী ব্যাংক কোনো টাকা পায়নি। 
অথচ গত রবিবার মুদ্রানীতি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নিত্যপণ্যের আমদানিতে এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া আছে। রমজানে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।