খুলনা | শুক্রবার | ০৯ মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

যুবকদের আত্মহত্যা ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
০১:৩১ এ.এম | ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩


একটি দেশের আপাত: বড় সম্পদ হলো যুবকরা। দেশ গড়ার পরবর্তী কান্ডারি হলো যুবকরা। স¤প্রতি যুবকদের মাঝে আশাহীনতার লক্ষণ বেড়েছে। বেড়েছে তাদের আত্মহত্যা প্রবনতাও। গবেষণায় দেখা গেছে- আত্মহত্যার সাথে আশাহীনতার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যক্তি যখন আশাহীনতায় ভোগে, তখন বেঁচে থাকার আশা তার ক্ষীণ হয়ে উঠে কারণ আশা মানুষকে বেঁচে থাকার স্বপ্নে সামনের দিকে অগ্রসর করে। আজ নানা কারণে যুবকরা আশাহীনতায় বেশি আবিষ্ট-যে কারণে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আকাশে যখন রংধনু দেখা যায়, তখন তাকে রোদ্র ও বৃষ্টি উভয়কে মোকাবেলা করে অতঃপর তাকে আকাশে আবির্ভাব হতে দেখা যায়। কিন্তু যারা আশাহীনতায় ভোগে, তারা কোন সমস্যাকে মোকাবেলা করার চেয়ে পালিয়ে যেতে পারলে বিজয় মনে করে।
স¤প্রতি আমাদের সমাজে যুবকদের আত্মহত্যা প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের অভিভাবক সমাজ তাদের সন্তানদের বর্তমান জীবনবোধকে কেন্দ্র করে বেশ উদ্বিগ্ন। অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সন্তানদের স্বচেতনায় আত্মহনন সদৃশ অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বর্তমান হালচাল প্রাজ্ঞ সমাজ থেকে সাধারণ মানুষের নিকট আজ মাথা বেদনার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
আজকের কৈশর ও যুব সমাজের প্রতি তাকালে দেখা যায়-তাদের মধ্যে আত্মসম্মানমূলক মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তাদের আত্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে বসেছে। বেশির ভাগ কৈশোর ও যুবক নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে সর্বাগ্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবার কারণে ছোট-খাট কোন বিষয় বা অপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে -তাদের মধ্যে হতাশা তথা আশাহীনতা ক্রমে সহজে মহীরুহ রুপ লাভ করার সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে। যুবকদের সংকীর্ণ আত্মবিশ্লেষণের ভাবধারার কারণে মা-বাবা, আপনজনদের মানসিক শাসন কেন্দ্রীক ভালোবাসার অনুভূতিকে তারা অনেক ক্ষেত্রে আমলে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের সন্তানরা একটা বয়সে পাশ্চাত্য ভাবধারায় নিজেকে খন্ডিত রুপে অবগাহন করতে প্রলুব্ধ হলেও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তদ্রুপ আত্ম শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। আমারা পরিবর্তনের ধারায় আবর্তীত হতে চাচ্ছি কিন্তু তা আমাদের যুব সমাজ অনেক ক্ষেত্রে গলার্ধঃকরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে একটা অপরিণত ও অরিপক্ক যুব সমাজ আমরা পেতে যাচ্ছি যারা শুধু নিজেদেরকে আত্ম স্তম্ভরিতামূলক ভাবধারায় সম্পৃক্ত করে ফেলতে শুরু করেছে, যেখানে মায়ের মাতৃত্বসুলভ ভালোবাসার তাগিদ বা সংসার চালনায় বাবার হাড় ভাঙা কষ্টের মূল্য যৎ সামান্য হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর তার সাথে যুক্ত হচ্ছে সতীর্থদের মানসিক চাপ ও নিপীড়নমূলক মনোভাব।
যুবকদের আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণ : (১) যুবকরা সমস্যা সমাধানে অপেক্ষাকৃত অনেক ক্ষেত্রেই বেশি জড়তাগ্রস্ত, (২) তারা বয়সে নবীন যে কারণে তাদের আচরণ অনিয়ন্ত্রিত ভাবাবেগ দ্বারা বেশি নিয়ন্ত্রিত, (৩) দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, তবে কর্মমুখি শিক্ষার ক্ষেত্র ও প্রসর আশানুরুপ বৃদ্ধি না পেয়ে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাওয়া-যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, (৪) মেয়েদের সাথে খোলামেলা সামাজিক মেলামেশা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামাজিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, (৫) আমাদের তথা যুবকদের সামাজিক ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সামাজিক দায় অনেক ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে-যে কারণে সহজে তারা বেশি আশাহীনতায় ভোগে থাকে ফলে আত্মঘাতিমূলক সিদ্ধান্ত তথা আত্মহত্যায় যুবকরা অতি সহজে প্রলুব্ধ হচ্ছে, (৬) পিতা-মাতার অর্থ অর্জনের পাগলপর নেশা, চাকুরি ও সামাজিক দায়িত্ব পালনগত ব্যস্ততা, সন্তাদের প্রতি অতিরক্ষণশীল বা অবহেলাসূচক মনোভাব, সাংসারিক অন্তঃকলহ বা বর্তমান ভঙ্গুর পারিবারিক অবস্থার বৃদ্ধি অথবা সন্তানের প্রতি মানসিক কেন্দ্রীক শাসনের অপ্রতুলতা ইত্যাদি যুবকদের আশাহীনতার পথকে সহজে প্রশস্ত করছে-যা তাদের বর্জনমূলক অবহিতিকে বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করছে,  (৭) আজকের যুবকরা অনেকেই নিজস্ব ক্ষমতার সাথে অসামঞ্জস্য ও অবাস্তব উচ্চাশা প্রকাশ করে এবং তা পূরণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হওয়ার দরুণ- সহজে জীবন থেকে পালায়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, (৮) আজকের যুবকরা পদে পদে ব্যর্থ হওয়ার দরুণ আশাহীনতা ক্রমে বৃহৎকার রূপ ধারণ করার জন্য মৃত্যু অবধারিত ভেবে সহজে অর্থহীন জীবনকে দ্রুত অর্থপূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, (৭) জীবন ও সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা যুবকদের তুলনামূলক কম থাকায় ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত ভাবে বিরাজমান অন্তনির্হিত মরণ প্রবৃত্তি সহজে জাগরিত হয়ে উঠে-ফলে  তারা সহজে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের করণীয় : (১) যুবকদের তীব্র মানসিক বেদনা ও কষ্টের অবসান ঘটানো যার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক সম্পর্ক জোরদারকরণ, (২) ব্যক্তির চোখের সম্মুখ হতে পক্ষপাতদুষ্ট মনোপর্দা সরিয়ে ফেলা যাতে সে অনস্তিত্ব ও অনন্ত দুঃখ কষ্ট ভোগ করা ছাড়া অন্য বিকল্প পথ সম্পর্কে ভাবতে পারে-তার জন্য তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন, (৩) ব্যক্তিকে আত্ম বিধ্বংসী কাজ হতে সামান্য পরিমাণ হলেও পিছু হটতে বা বিরত থাকতে উৎসাহিত করা, (৪) হতাশাগ্রস্ত যুবকদের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করা, (৫) সামাজিক সম্পর্ক তথা বন্ধু-বান্ধব, আত্ম-পরিজনের সাথে মেলামেশা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। 
আত্মহত্যা  পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি সবার জন্য পরম দুঃখ ও কষ্টের। আত্মহত্যার মাধ্যমে পাবার কিছু নাই বরং আত্মহত্যার পরিণতিতে বহন হয় করতে আধ্যাত্ম জগতের দুঃখ ও যন্ত্রণা। তাই আসুন-সমস্বরে বলি:-‘আত্মহত্যাকে না বলি, সুন্দর জীবন গড়ি’। 
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ,খুলনা। ফ্রি পরামর্শ-০১৭১৪-৬১৬০০১।