খুলনা | শনিবার | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মহামারীর মধ্যেও কোমলমতি শিশুদের নিয়ে ভর্তি কোচিং

অনলাইন ক্লাসের নামে কিন্ডারগার্টেনের বিরুদ্ধে অর্থ আদায়ের অভিযোগ

আশরাফুল ইসলাম নূর |
১২:৪৯ এ.এম | ০৯ অগাস্ট ২০২১

নগরীর জোহরা খাতুন শিশু বিদ্যা নিকেতন, অফিসিয়ালি বন্ধ রয়েছে। তবে অনলাইন ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠছে। হাতে গোনা কয়েকটি অনলাইন ক্লাস নেয়া হলেও কার্যতঃ তা উপকারে আসেনি কোমলমতি শিশুদের। সহস্রাধিক শিশুর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হলেও শিক্ষক, কর্মচারীদের দেয়া হচ্ছে না বেতন-ভাতা। ক্ষতিগ্রস্ত কোমলমতি শিশুর অভিভাবক ও শিক্ষকদের অভিযোগ এমনি। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্কুলটির অধ্যক্ষ সারা চৌধুরী। এমনি অভিযোগ শুধু জোহরা খাতুন স্কুলের বিরুদ্ধে নয়, খুলনার অধিকাংশ স্কুলে ভর্তি কোচিং ও কিন্ডারগার্টেনের বিরুদ্ধে। গেল বছর লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলেও, নগরীর একাধিক কিন্ডারগার্টেন ও কোচিং সেন্টারে ৩য় শ্রেণির ভর্তি কোচিং করাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে গেল বছরের ন্যায় লটারীর সিদ্ধান্তেই এখনো পর্যন্ত অটল রয়েছে ভর্তি কমিটি।

সরেজমিনে ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে নগরীর পিটিআই মোড় সংলগ্ন হিরণ স্যারের ব্যাচ চলছে মহাসমারোহে। রীতিমতো ফেসবুকে সরাসরি স¤প্রচার করা হচ্ছে কোচিংয়ের পাঠদান, পরীক্ষা ও আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। হাজী মহসিন রোডের মোস্তাফিজ স্যারের সোনার বাংলা স্কুলটির নাম শুনে মনে হতে পারে বিদ্যালয়; কিন্তু না, এটা মূলতঃ কোচিংই। জিলা, করোনেশন স্কুলের ভর্তি ইচ্ছুকদের বিশেষ কোচিংটি চলছে করোনার মধ্যেই। আবার, দোলখোলার অঙ্কুর বিদ্যাপীঠের বিজয় কুমার সরকার নিজের বাসায় অতি গোপনে কোচিং করাচ্ছেন। পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকায় হিমাংশু সরকারের কলকাকলি শিশু শিক্ষালয়, জোহরা খাতুন স্কুলের পাশে সনজিৎ কুমার পরিচালিত আস্থা কিন্ডারগার্টেনে নিজেদের বাসায় ক্লাস নেয়া হয় বলে জানা গেছে। এছাড়া বয়রায় পাবলিক কলেজের সামনে প্রসেনজিৎ স্যার পরিচালিত অক্ষর বিদ্যাপীঠ করোনাকালে কখনোই বন্ধ ছিল কি না, স্মরণ করতে পারছেন না অভিভাবকরা।

এভাবে নগরীর অসংখ্য কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও ভর্তি কোচিং অনলাইনে ক্লাসের নামে অভিভাবকদের জিম্মি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কখনো সরকারি আদেশ অমান্য করে অনলাইনের পরিবর্তে অফলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। কোন কোন কোচিং বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে দশ/পনের জন করে নিয়ে ব্যাচ করছে। এসব কিন্ডারগার্টেন এবং কোচিং সেন্টারগুলো অভিভাবকদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। তবে কোমলমতি সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে এসবের প্রতিবাদ করছেন না তারা। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে পরিচালকদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে; এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। তবে খুলনা মহানগরীতে ১২৬টি এবং জেলাতে প্রায় ৩৮৯টি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে।

অভিভাবকরা বলছেন, কিন্ডারগার্টেন এবং কোচিং বাণিজ্য করোনাকালীন বন্ধ রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে ঘোষণা দিতে হবে যে, গত বছরের মতো এ বছরও সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা লটারির মাধ্যমে হবে। তাহলে অভিভাবকরা জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত হবেন এবং তারা তাদের সন্তানদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে বাধ্য হবেন না। এতে শিশুরা মানসিক চাপমুক্ত হবে। অভিভাবকরা দুশ্চিন্তামুক্ত হবেন। কোচিংগুলোর অবৈধ অর্থ উপার্জন বন্ধ হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হবে না। করোনা প্রতিরোধে বিধি-নিষেধ প্রতিপালন ব্যাহত হবে না।

নগরীর মুন্সিপাড়ার ‘শিক্ষা শেকড় বিদ্যাপীঠ’-এ অনলাইনে ক্লাসের নামে অর্থ হাতিয়ে নেবার অভিযোগ অস্বীকার করে এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ও খুলনা কোচিং পরিচালক এসোশিয়েশনের সভাপতি কাজী জলিল বলেছেন, করোনা মহামারীতে সরকার নির্বাহী আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানিয়ে কোচিং, শিশুতোষ স্কুলসমূহ বন্ধ রেখেছি। সরকারি আদেশ অমান্য করে কেউ প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে এমন তথ্য আমার জানা নেই। যদি কেউ সরকারের নির্বাহী আদেশ অমান্যকরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে রাখে বা মাঝে-মাঝে খোলে তাহলে আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে তীব্র  নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি যে বা যারা এই কাজের সাথে যুক্ত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের এ সহ-সভাপতি।

অনলাইনে ক্লাসের জন্যে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জোহরা খাতুন শিশু বিদ্যা নিকেতনের অধ্যক্ষ সারা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে ক্লাসের জন্যে তো কোন বাড়তি টাকা নেয়া হচ্ছে না। শুধু মাসিক বেতনটিই নেয়া হয়।’ করোনা পরিস্থিতিতেও শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন নেয়া হচ্ছে, সেটা তার বক্তব্যেই স্পষ্ট।

বাংলাদেশ কোচিং সেন্টার এসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি মির্জাপুর রোডের শিক্ষা সাগর’র পরিচালক এবং শ্যামল কুমার রায় বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে কিছু শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা করা হয়। তাদের থেকে সর্বোচ্ছ এক হাজার টাকা করে নেয়া হয়। অফলাইনে বা স্কুলে এসে কাউকে পড়ানো হয় না বলে দাবি করেছেন তারা।

খুলনা জেলার সরকারি স্কুলসমূহে ভর্তি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সচিব জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারহানা নাজ সময়ের খবরকে বলেছেন, “ভর্তি প্রক্রিয়া এ বছর কেমন হবে সেটা এখনি স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। ভর্তির কিছুদিন পূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তি নীতিমালা দেয়া হয়, সে অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের দায়িত্ব। গত বছর করোনায় যখন দৈনিক ১৫ থেকে ২০ জনের মৃত্যু হচ্ছিল তখন লটারীর মাধ্যমে ভর্তি করানো হলো; আর এখন তো আড়াইশ’র ওপর দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা। তাহলে কি হবে...?”

প্রসঙ্গত, মহামারী করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কয়েক ধাপে এই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে এখনো ঘোর অনিশ্চয়তা রয়েছে।