খুলনা | শুক্রবার | ০৯ মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

তৈরি হয়েছে ৮শ’ কোটি টাকার মাছ এবং সবজির বাজার

কৃষিতে আধুনিকায়ন, বাড়ছে কৃষক উদ্যোক্তা দেশের বড় অর্থনৈতিক জোন ফকিরহাট

রামিম চৌধুরী |
০১:০৭ এ.এম | ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩


দক্ষিণের একটি প্রাচীন জনপদ বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলা। ১২শ’ শতাব্দির দিকে ভৈরবের পাড় ঘিরে গড়ে ওঠা এ উপজেলা এখন দেশের একটি বড় অর্থনৈতিক জোন। এ উপজেলার বুক চিরে তৈরি হয়েছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। উন্নত হয়েছে এ উপজেলার সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফকিরহাট উপজেলায় মাছ ও সবজি চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে চাষিরা। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। এখান থেকেই বছরে শত কোটি টাকার সবজি ও মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে দেশি ও বিদেশি বাজারে। সেই সাথে তৈরি হচ্ছে নতুন কৃষক উদ্যোক্তা। বছরে প্রায় ৮শ’ কোটি টাকার মাছ এবং সবজির একটি বড় অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হয়েছে এ উপজেলা। এছাড়াও বিদেশের বাজারে চিংড়ি রপ্তানি করে আয় হচ্ছে শত কোটি টাকা। ভাল যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এ উপজেলায় বাড়ছে কৃষক উদ্যোক্তার সংখ্যা। 
এ উপজেলার ফলতিতা এলাকায় যে দিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই বিস্তীর্ণ জলরাশী। শত শত বিঘা জমিতে চাষ হয় বিভিন্ন ধরনের মাছের। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তা চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। ফকিরহাটে চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে চাষিরা। ফলে তৈরি হয়েছে চিংড়ির বড় একটি বাজার। এখান থেকে সাদাসোনা খ্যাত গলদা চিংড়ি বিদেশী বাজারে রপ্তানি করে আয় করা হচ্ছে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।  
ফকিরহাটের ফলতিতা এলাকার মৎস্য চাষি সমর পাত্র। ঘেরে চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের সাদা মাছের চাষ তার। ২ দশক আগে ৪ বিঘার একটি ঘেরে মৎস্য চাষ শুরু করলেও এখন তার চাষের জমির পরিমাণ ৬০ বিঘা। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে মাছের চাষ ভাল হওয়ায় লাভবান হন তিনি। তবে বর্তমানে খাবারের দাম বাড়ার কারনে কিছুটা সংকটে পড়তে হচ্ছে। এখন ৫শ’ টাকার একবস্তা মাছের খাবারের দাম দিতে হচ্ছে ১ হাজার টাকা, তবে মাছের দাম বাড়েনি বলে জানান তিনি। 
সমর পাত্রের মত এ উপজেলায় মৎস্য চাষি রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি, রুই, কাতলাসহ চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মাছের। মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছে চাষিরা। তবে মাছের খাবারসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সকল মাছ চাষিদের। 
এসব চাষের মাছ বিক্রির জন্য ফলতিতা এলাকায় ৯০ এর দশকে গড়ে ওঠে পাইকারী মাছের বাজার। শুরুটা সল্প পরিসরে হলেও এখন মৎস আড়তের সংখ্যা দেড়শ’ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন সকালে চাষিরা মাছ ধরা শেষে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে এ বাজারে। বিক্রেতাদের হাকডাকে মুখরিত হয় আড়ৎ এলাকা। প্যাকেজিং শেষে এখান থেকেই পাইকারদের মাধ্যমে মাছ চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। 
উপজেলা মৎস অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছরই বেড়েছে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ। বছরে ৩ হাজার ১৯ মেট্রিকটন মাছের চাহিদা থাকলেও এ উপজেলা থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ৬ হাজার ৩৫০ মেট্রিকটন। এর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৬ হাজার ২৫০ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজার ১২৭.০৫ মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন করা হয় এ উপজেলা থেকে। 
ফকিরহাটের মূলঘর ইউপি চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার সময়ের খবরকে বলেন, এ উপজেলার ফলতিতা এলাকার আড়ৎ গুলোতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ বেচা-কেনা হয়। যা বছরে ছাড়িয়ে যায় ৬শ’ কোটি টাকা। এখান থেকে চিংড়ি রপ্তানি করে আয় হয় বৈদেশিক মুদ্রা। তবে অতিলোভের আশায় কিছু অস্বাধু ব্যবসায়ীর চিংড়িতে অপদ্রব্যপুশের কারনে বৈদেশিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা কমছে বলে জানান তিনি। 
এদিকে ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নে প্রায় ২শ’ বিঘা জমিতে চাষ হয় বিভিন্ন ধরনের অর্গানিক সবজির। সকাল হতে না হতেই কেউ মাঠ থেকে সবজি তুলতে, আবার কেউ বা ক্ষেতের পরিচর্যায় লেগে পড়েন। এখানে কোন প্রকার সার বা কিটনাশক ছাড়াই চাষ করা হচ্ছে ফুলকপি, বাধাকপি, টমেটো, আলুসহ হরেক রকম সবজির। ভাল লাভ পাচ্ছেন বলে জানান সেখানকার চাষীরা। 
অর্গানিক সবজি ছাড়াও এ উপজেলার প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে ৫ হাজারের বেশি কৃষক উদ্যোক্তা চাষ করেন বিভিন্ন ধরনের সবজির। যা পদ্মা সেতু পার হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে বছরে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার সবজি যাচ্ছে সারাদেশে। 
বেতাগা ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ইউনুস আলী ও ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আনন্দ দাশ সময়ের খবরকে জানান, এ উপজেলায় সবজি চাষের পাশাপাশি চাষ হয় পেয়ারা, লেবুসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের। এখান থেকে পাইকাররা ফল কিনে নিয়ে পাঠায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিগত বছর গুলোর তুলনায় এ বছর চাষ ভাল হওয়ায় খুশি কৃষকরা। 
উপজেলার সকল কৃষককে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। সেই সাথে নানা ভাবে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নাছরুল মিল­াত। 
ফকিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন দাশ সময়ের খবরকে বলেন, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। উৎপাদিত ফসল বাজারে পাঠানোর জন্য কৃষকদের দেওয়া হয়েছে ভ্যান। এর পাশাপাশি গ্রামের রাস্তাগুলো পাকা করার কারনে সহজেই বড় গাড়িতে করে সবজি সরবরাহ করতে পারছে কৃষকরা। কিছুদিন আগেও ফকিরহাট থেকে উৎপাদিত পণ্য সারাদেশে পাঠাতে সমস্যায় পড়তে হতো যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে। তবে পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ সংকট কেটেছে বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান। 
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মনোয়ার হোসেন সময়ের খবরকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কৃষির বিকল্প নেই। তাইতো ফকিরহাট উপজেলায় বাড়ছে শিক্ষিত কৃষক উদ্যোক্তার সংখ্যা, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের। ‘স্মার্ট ফকিরহাট’ তৈরিতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। ফকিরহাট উপজেলায় প্রায় সব ধরনের কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে নানামুখি প্রশিক্ষণ। ৫ হাজারেরও বেশি কৃষক উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে। বেড়েছে এ উপজেলার বাৎসরিক মুনাফার হার। ফকিরহাটের কৃষিতে আধুনিকায়ন ও সমন্বিত কৃষি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করে অধিক মুনাফা আয় করা সম্ভব বলে জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার।