খুলনা | মঙ্গলবার | ১৩ মে ২০২৫ | ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

হাদিসের আলোকে শাবান মাস ও শবে বরাতের গুরুত্ব

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০২:২৪ এ.এম | ০৩ মার্চ ২০২৩


শাবান মাস বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। রমজানের আগের মাস হলো ‘শাবান’ মাস। এ মাস রমজানের প্রস্তুতির মাস। এই মাসের মধ্যভাগে রয়েছে পবিত্র শবে বরাত। এই শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ রাতে মহান আল­াহ তায়ালা অসংখ্য মানুষকে মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। এ কারণে এই রাতকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনী বলা হয়। এ মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বতন্ত্র ও ইসলামি ঐক্যের মাস, তেমনি এ মাসে রয়েছে মুক্তির এক বিশেষ রজনী বা শবে বরাত। হিজরতের দেড় বছর পর পুরাতন কিবলা ফিলিস্তিনের ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’-এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই।  
হাদিসের ভাষ্য অনুসারে, রজব আল­াহ তাআলার মাস, শাবান নবীজি (স.)-এর মাস, রমজান হলো উম্মতের মাস। রসূলুল­াহ (স.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত করতেন এবং রোজা রাখতেন। রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের নফল রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিহ হাদিসে আয়িশা (রাঃ) বলেন, রসূলুল­াহ (স.) কে আমি শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে এত অধিক নফল রোজা পালন করতে দেখিনি। তিনি যেন গোটা শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। তিনি সামান্য (কয়টি দিন) ব্যতীত গোটা শাবান মাস রোজা রাখতেন (সহিহ মুসলিম)। মহানবী (স.)  এক ব্যক্তিকে বললেন, তুমি কি এ মাসের অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যেভাগে কিছু দিন রোজা রেখেছো? সে বলল, না। তিনি তাকে বললেন, রমযানের রোজা পালন শেষ করে তুমি এক দিন বা দুই দিন রোজা রাখবে (মুসলিম:২৬২৪)। আর এক হাদিসে এসেছে, আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল­াহ (স.) শাবান মাস ব্যতীত বছরের অন্য কোন মাসে এত অধিক রোজা পালন করতেন না। তিনি বলতেনঃ “তোমরা যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে ভাল কাজ কর। কারণ আল­াহ তা’আলা সওয়াব দিতে কখনও ক্লান্ত হন না বরং তোমরাই আমল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়” (মুসলিম:২৫৯৪)। 
শবে বরাতের ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। বিশিষ্ট সাহাবি মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, ‘আল­াহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ এই হাদিস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, এ রাতে আল­াহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল­াহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা হয় তখন তার অর্থই এই হয় যে, এই সময়ে এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যতœবান হতে হবে, যার মাধ্যমে আল­াহর রহমত ও মাগফিরাতের উপর্যুক্ত হওয়া যায়। আর ওইসব গুণাহ থেকে বিরত থাকতে হবে, যার কারণে মানুষ আল­াহ তায়ালার রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু উপরোক্ত হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফিরাতের ঘোষণা আছে, তাই এ রাতটি অনেক আগে থেকেই শবে বরাত তথা ‘মুক্তির রজনী’ নামে প্রসিদ্ধ। কেননা, এ রাতে গোনাহ থেকে ও গোনাহর অশুভ পরিণাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি শবে বরাতের ফজিলতের বিষয়ে দ্বিতীয় কোনো হাদিস নাও থাকত, তাহলেও এই হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফিরাতের উপযোগি নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। অথচ হাদিসের কিতাবগুলোতে নির্ভরযোগ্য সনদে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একবার আল­াহর রসূল (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল­াহর রসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রসূলুল­াহ, আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি ইন্তেকাল করেছেন কি না। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল­াহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন ‘এটা হলো অর্ধ-শাবানের রাত। আল­াহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (বাইহাকি ৩/৩৮২-৩৬৮)।  আল­াহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শাবান মাসে বেশি বেশি আমলের তাওফিক দান করুন। 
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনী থেকে)