খুলনা | শনিবার | ১০ জুন ২০২৩ | ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

দফায় দফায় বৈঠকেও মেলেনি সমাধান চিকিৎসক কর্মবিরতিতে ভোগান্তি চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:৪৩ এ.এম | ০৪ মার্চ ২০২৩


চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকায় খুলনায় ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবা। দফা দফা বৈঠক করেও কোন পক্ষই সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় ছাড়াও স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত হলেও চিকিৎসক নেতারা না আসায় সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খুলনা সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। তবে বিভাগীয় কমিশনার মোঃ জিল­ুর রহমান চৌধুরী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চিকিৎসক সমাজ শনিবার কর্মস্থলে যোগদান করবেন। অন্যদিকে চিকিৎসক নেতা ডা: বাহারুল আলম কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। 
এর আগে বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দলের সাথে চিকিৎসক নেতা টানা ৪ঘন্টা বৈঠক শেষে অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রশাসন ডাঃ রাশিদা সুলতানা বলেছেন কর্মবিরতি কোথায় পেলেন, সব কিছু স্বাভাবিক রয়েছে। রোগী সেবা পাচ্ছে, ভর্তি হচ্ছে অপারেশন হচ্ছে। অথচ খুলনা বিএমএ সভাপতি বলেছেন আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসাবে কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। শনিবার আবু নাসের হাসপাতালে দুপুর ১২টায় বিক্ষোভ সমাবেশ। 
এর আগে শুক্রবার বিকেল ৩টায় বিএমএ ভবনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসক নেতাদের সাথে বৈঠক শুরু হয়, শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। সন্ধ্যা ৬টায় প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল। তবে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কোন ফলাফল জানা যায়নি।
অপর দিকে শুক্রবার দুপুর ৩টা থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চিকিৎসক নেতাদের বৈঠক হয়। আড়াই ঘণ্টা বৈঠকের পর কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) রাশিদা সুলতানা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অ্যাডমিন) সামিউল সামিউল ইসলামসহ চারজন ও বিএমএ খুলনার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মেহেদি নেওয়াজসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এদিকে খুলনায় চিকিৎসকের উপর হামলার ঘটনায় তৃতীয় দিনের কর্মবিরতি অব্যাহত ছিল। দফায় দফায় বৈঠক করেও কোন সমাধান হয়নি। ফলে চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রোগীরা। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন রোগীরা। প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসা নিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।
নাগরিক নেতারা দাবি জানিয়েছেন কর্মসূচি প্রত্যাহারের। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করলেও বিএমএ নেতারা তা অস্বীকার করেছেন।
বিএমএ খুলনার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম বলেন, চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় কর্মসূচি চলছে। তবে জরুরি চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে।
অপর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) রাশিদা সুলতানা বলেন, তাঁরা দেখতে এসেছিলেন। দেখে গেলেন। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আর জরুরি চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
অপর দিকে জন উদ্যোগ খুলনার সদস্য সচিব মহেন্দ্রনাথ সেন বলেন, জনগণকে ভোগান্তি রেখে কোনো আন্দোলন মেনে নেওয়া যায় না। তিনি কর্মবিরতি প্রত্যাহারের দাবি জানান।
এদিকে বিএমএ সাধারণ সম্পাদক মেহেদি নেওয়াজ স্বীকার করেন কর্মবিরতির কারণে কিছুটা হলেও চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
হাসপাতালের হালচিত্র : খুলনার কয়রা থেকে লাভলি বেগম (৬০) নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন আকলিমা বেগম। মা স্ট্রোক করেছিলেন। তার ডায়াবেটিকস, হাইপ্রেসার রয়েছে। গত চারদিন এখানে রয়েছি। এই সময়ে বড় ডাক্তার আসেনি। নার্সরা আসছেন। মা মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। চারদিন বসে আছি, আর কয়দিন বসে থাকবো জানি না। ঠিকমতো সেবা পেলে মা সুস্থ হয়ে যেতো।
হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজন শেখ মোঃ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কালিয়া থেকে ডেলিভারি রোগী নিয়ে খালিশপুর ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। সেখানে ডাক্তার না থাকায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে বড় ডাক্তার নেই। নার্সরা দেখাশোনা করছেন। ডাক্তার কখন আসবে না আসবে, কি হবে? এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। সাধারণ মানুষেরতো ভোগান্তি। আমরা দ্রুত এর অবসান চাই এবং সাধারণ রোগীরা যাতে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে তার আশু কামনা করছি।
এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় আকরাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার নানীকে নিয়ে গত ৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি। সিনিয়র কোনো চিকিৎসক আসেননি। জুনিয়র চিকিৎসক দেখছেন। মো. আনেয়ার ইসলাম নামের আরেজন জানান, তিনি মাকে নিয়ে ৪ দিন আছেন হাসপাতালে। প্রথমদিন চিকিৎসক যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেভাবেই চিকিৎসা চলছে।
খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ মেহেদী হাসান বলেন, কর্মসূচি চললেও রোগী আমরা দেখছি। বৃহস্পতিবারও সিনিয়র চিকিৎসকরা এসে রোগী দেখেছেন। এখানে প্রতিনিয়ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। তাদেরতো দেখতে হবে। আমরা সেবার দিকটি খেয়াল রাখছি।
রোগী ভোগান্তির বিষয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ রবিউল হাসান বলেন, প্রত্যেকদিন হাসপাতালে সাধারণত ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ রোগী থাকছে। নরমাললি ১৫ থেকে ২০ জন রোগী প্রত্যেক দিনই মারা যায়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একসঙ্গে ধর্মঘটের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ও রোগী মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, গত ২৭ ফেব্র“য়ারি ১৪০০ রোগী ছিল। এর মধ্যে মারা গেছে ২০ জন, ২৮ ফেব্র“য়ারি রোগী ছিল ১৩৪৫ জন, ১৭ জন মারা গেছে। আর ১ মার্চ রোগী ছিল ১৪১৮ জন, মারা গেছে ২০ জন। ২ মার্চ রোগী ছিল ১৩১০ জন, ১৬ জন মারা গেছে। এর মানে আমরা দেখছি যে ধারাবাহিকতা একভাবেই আছে। যেমন মারা যায় তেমনই আছে। ধর্মঘটের জন্য বেশি মারা গেছে এমন কোন কথা নয়। আর দায়িত্বে অবহেলার জন্য কোন রোগী মারা যায়নি।
তিনি বলেন, আমাদের জরুরি সেবা কিন্তু সব সময় চালু আছে। হাসপাতালের ভিতরের সেবা চালু আছে। ডাক্তাররা সব সময় রাউন্ড দিচ্ছেন। 
চিকিৎসকরা জানান, গত ১ মার্চ থেকে কর্মবিরতিতে রয়েছেন তারা। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বিএমএ খুলনার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিভাগীয় কমিশনার মোঃ জিল­ুর রহমান চৌধুরী। এ সময় তিনি রোগীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদেরকে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেন। এছাড়া বিএমএ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সংগঠনের খুলনা নেতাদেরকে ফোন করে একই নির্দেশনা দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) বেলা ১১টায় শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল চত্বরে যে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কর্মসূচি ছিল তা বাতিল করা হয়। বেলা ১১টায় খুলনা বিএমএ কার্যালয়ে জরুরি সভা করেন চিকিৎসকরা। 
জরুরি সভা শেষে খুলনার বিএমএ সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম বলেন, খুলনার শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের ডাঃ নিশাত আব্দুল­াহর ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমকে গ্রেফতার এবং দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
এরপর শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খুলনা সার্কিট হাউজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে বসেন প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সাড়ে ১১টায় কোন সমাধানের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মিটিং চলাকালীন পরিচালক প্রশাসন ছুটে যান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে চিকিৎসাধীন ডাঃ নিশাত আব্দুল­ার কাছে। সেখানে কিছুক্ষণ পর তার পরিবার ও অভিযুক্ত পুলিশের এএসআই নাইম ও তার স্ত্রী নুসরাতও যায় বলে খবর পাওয়া গেছে বিভিন্ন সূত্রে। তবে সেখানে কি কথা হয়েছে জানা যায়নি।
আজ শনিবার দুপুর ১২টায় আবু নাসের হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশেরও ডাক দেওয়া হয়। এ ছাড়া সন্ধ্যা ৭টায় বিএমএ কার্যালয়ে সংগঠনের জরুরি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।