খুলনা | মঙ্গলবার | ১৩ মে ২০২৫ | ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

অগ্নিঝরা মার্চ

মাওলা বকস্ |
০১:৫৫ এ.এম | ১৯ মার্চ ২০২৩


আজ ১৯ মার্চ ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতেও ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। এক অনন্য দুঃসাহসিক মহিমায় ভাস্বর এ দিনটি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে  যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই ১৯ মার্চ ’৭১ এ গাজীপুর থেকে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম শুরু হয়েছিল বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ দিনটি প্রথম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল স্বাধীনতার জন্য গাজীপুরের সংগ্রামী জনতার হাতের অস্ত্রে প্রথম গুলি। দেশের সমগ্র জাতিকে সেদিন গাজীপুরবাসী দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ আর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার বলীয়ান। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গাজীপুরবাসীর রয়েছে কৃতিত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় ভূমিকা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হাজার বছরের চিরায়ত এ জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট ও মহিমান্বিত দিকটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বিজয়ের গৌরবদীপ্ত মহিমান্বিত দিনটি অবিস্মরণীয় তাৎপর্যে আজও গাজীপুরের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে জাতীয় জীবনে।
১৯৭১ সালে বাঙালিদের আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং ষড়যন্ত্রের নীল নকশা অনুযায়ী ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি  সৈনিকদের কৌশলে নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে ১৫ মার্চের মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্টর (৩০৩ কেলিবার) রাইফেলগুলি সদর দফতরে জমা দেয়ার জন্য ঢাকা ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ খবর বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমে শোনার পর জয়দেবপুর এলাকার আশপাশের এবং টঙ্গীর জনগণের ও শ্রমিকের মধ্যে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনতা ঢাকা চৌরাস্তা জয়দেবপুর সড়কের টঙ্গী, চৌরাস্তা, মেশিন টুলস, ফ্যাক্টরি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ইট, গাছের ডুম, ঠেলাগাড়ী দিয়ে প্রায় ৪০/৫০টি ব্যারিকেড তৈরি করে।
মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সকাল থেকেই হাতে আড়াই হাত লম্বা লাঠি, রামদা, কার্টুজ/বন্দুক, হকিস্টিক, তীর ধনুক, বল­াম ইত্যাদি নিয়ে জয়দেবপুর বাজার বটতলায় জমায়েত হতে থাকে এবং জনতার ঢল নামতে থাকে পাক বাহনীকে অস্ত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে। মুক্তি সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হাজার হাজার জনতা শ্রমিককে উদ্বুদ্ধ করতে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। জনতা সাথে সাথে পাক সেনাদের ক্যান্টমেন্ট যাওয়ার একমাত্র প্রবেশ পথ রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য বাজারের বটতলা সংলগ্ন রেলক্রসিং গেইটে একটি মালগাড়ীর বগি ঠেলে এনে ব্যারিকেড তৈরি করেন এবং রেল লাইনের নীচ থেকে কাঠের স্লিপার সরিয়ে ফেলেন। সেদিনের ঐতিহাসিক শ্লোগানে শ্লোগানে এলাকা হয়েছিল মুখরিত হয়ে উঠেছিল।বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের নিকট থেকে ৪টা চাইনিজ রাইফেল ও ১টি এসএমজি ছিনিয়ে নিয়ে ৫ জনকে বন্দি করে। ড্রাইভার ও অপর একজন সৈন্য পালিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঘটনা অবগত করালে ব্রিগেডিয়ার জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে নিদের্শ দিলেন। মেজর মঈনের ইঙ্গিতে সেনারা উপর দিকে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। অজগ্র গুলির আঘাতে দেবদারু গাছের ডাল ও পাতাগুলি ঝড়ের বাতাসের মতো উড়তে থাকে। শিলাবৃষ্টির ন্যায় গুলি ছুড়তে থাকে পাক সেনারা এতে উভয় পক্ষেই হতাহত হয়। ঐদিন গুলিতে মনু খলিফাও কিশোর নেয়ামত মারা যান। আহত হন ডাঃ ইউসুফ, সন্তোষ কুমার মলি­ক, শাহজাহানসহ আরো অনেকে। সারাদেশে এ দিনের ঘটনায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সারাদেশে এ আওয়াজ উঠেছিল, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পরবর্তীতে জয়দেবপুরের বীর জনতার পথ ধরেই, অনুসরণ করেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রাম ও বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্জলিত হয়ে উঠে। বিদ্রোহী মার্চে ১৯ মার্চ কেবলমাত্র একটি তারিখই নয় ১৯ মার্চ বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থান নেয়ার পথিকৃত অগ্রদূত এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন।
ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাস্তা। আর এই চৌরাস্তার উপরই রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী। একজন মুক্তিযোদ্ধার বাম হাতে ধরা রাইফেল। ডান হাতে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে উদ্যত। ১৮ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটি ২২ ফুট উঁচু একটি বেদীর উপর নির্মিত। ভাস্কর্যটির চারদিক জুড়ে রয়েছে ২০৭ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নাম। যারা ১৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর ও ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
জাগ্রত চৌরঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ এই জয়দেবপুরের জনতা খালি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাক বাহিনীর ওপর। গাজীপুরের ফুটবল খেলোয়ার হুরমত উল­াহ পাক সেনাদের প্রতিরোধের সময় একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে ঝাপটিয়ে ধরে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু হুরমত উল­াহ জানতেন না কিভাবে রাইফেল চালাতে হয়। পরে একজন পাক সৈন্যের গুলিতে শহিদ হন তিনি।
জাগ্রত চৌরঙ্গী ভাস্কর্যটি তৈরি হয় এই ফুটবল খেলোয়াড় শহীদ হুরমত উল­াহর স্মরণে। সেদিন শুধু হুরমত উল­াহই নন, পাকবাহিনীর গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন নেয়ামত আলী ও মনু খলিফা। জয়দেবপুর বাসীদের সেদিনের ওই সাহস আর প্রতিরোধের শিক্ষা ছিল মুক্তিযুদ্ধের আগাম অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধ জয়দেবপুর বাসী ও দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের  সৈন্যদের এই আত্মত্যাগের বীরত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাগ্রত চৌরঙ্গীর মাধ্যমে। ১৯৭২- ৭৩ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্যটি ভাস্কর প্রবীণ শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক মুক্তিযোদ্ধার ছবি অবলম্বনে দীর্ঘ এক বছর পরিশ্রম করে তিনি এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।