খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

আসুন! ঔষধ ছাড়াই মানসিক আঘাত জনিত পীড়নকে ‘না’ বলি

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
০১:১৬ এ.এম | ২৫ মার্চ ২০২৩


মানুষ মাত্র সুস্থ জীবনের প্রত্যাশী। কিন্তু প্রকৃতি অথবা বাস্তবতার নিকট হেরে গিয়ে মানুষের জীবনে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো মানসিক  আঘাত পরবর্তী পীড়ন যা জীবনের চলার সাধারণ ছন্দকে নস্যাত করে জীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। ডিএসএম-৩- ১৯৮০ সাল হতে মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়নকে গুরুতর মানসিক পীড়ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সাধারণত ব্যক্তির কোন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু, বা কোন দুর্ঘটনার শিকার হওয়া-ইত্যাদি কারণে এরুপ পীড়নমূলক বিকৃতি দেখা দিতে পারে।
মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতির লক্ষণ : (১) ব্যক্তি কোন দুঃখদায়ক বা বেদনা দায়ক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, যেখানে : (ক) ব্যক্তি নিজে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বা দুর্ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। এরূপ দুর্ঘটনা সম্মুখীন হওয়ার ফলে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারতো অথবা গুরুতর জখম হতে পারত। (খ) ব্যক্তি কোন জটিল রোগের সম্মুখীন হয়েছে যেখানে তার মৃত্যু হতে পারত। (২) বেদনাদায়ক ঘটনাটির অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে (অন্ততঃ এক বা একাধিক উপায়),  যেমন : (ক) ঘটনাটির দুঃসহ স্মৃতি ব্যক্তির নিকট বার বার ফিরে আসে। (খ) ব্যক্তি বেদনা দায়ক ঘটনাটি বার বার স্বপ্ন দেখে। (গ) ঘটনাটি ঘটার সময়ে ব্যক্তির মধ্যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার স্মৃতি বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটে। (ঘ) ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক সংকেত উপস্থিত হলেই ব্যক্তির মধ্যে মানসিক পীড়ন দেখা দেয়। (৩) বেদনাদায়ক ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপক গুলিকে ব্যক্তি এড়িয়ে যেতে চায় (নিম্নের যে কোন তিনটি লক্ষণ থাকতে হবে), যেমন: (ক) ব্যক্তি বেদনাদায়ক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট চিন্তা, অনুভূতি বা কথাবার্তা এড়িয়ে যেতে চায়। (খ) অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বা বিচ্ছিন্নতা বোধ দেখায়। (গ) ব্যক্তির মধ্যে আবেগের সংকীর্ণতা (যেমন: ভালবাসা লাভের অক্ষমতা ) দেখা যায় (ঘ) ব্যক্তি ভবিষ্যতের জন্য উদ্দেশ্যহীন আচরণ প্রদর্শন করে ( যেমন: ব্যক্তির বিবাহ, জীবিকা, সন্তান-সন্ততি ধারণ বা পালন ইত্যাদি সম্পর্কে কোন লক্ষ্য থাকে না) (৪) ব্যক্তি বেশির ভাগ সময়ে অভ্যন্তরীণ ভাবে বেশ উত্তেজিত থাকে (নিম্নের লক্ষণ গুলির দু’টি বা ততোধিক থাকতে হবে), যেমন: (ক) ব্যক্তি সহজে ঘুমাতে পারে না (খ) প্রায় অতিরিক্ত চমকে উঠে (গ) ব্যক্তি বিভিন্ন কাজে অতি সতর্কতা প্রদর্শন করে। (ঘ)  মনোযোগের অসুবিধা দেখা দেয় (ঙ) খিটখিটে মেজাজ প্রদর্শন করে। (চ) ব্যক্তি আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করে।
ডিএসএম-৫ অনুযায়ী এরূপ লক্ষণ সমূহ যদি ব্যক্তির মধ্যে এক মাসের বেশি স্থায়ী হয় তবে তাহা মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়ন জনিত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। সাধারন্ত এ লক্ষণ সমূহ ব্যক্তির সামাজিক, বৃত্তিমূলক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্য তৈরি করে।
মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়ন দূরীকরণে কতিপয় মানসিক চিকিৎসা : (১) উত্তেজনার হ্রাস করণ নিমিত্তে শ্লথন পদ্ধতির অভ্যাস করুন : মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়নের কারণে ব্যক্তির শরীরের মধ্যে এক প্রকার উত্তেজনা তৈরি হয়। এরূপ উত্তেজনা ব্যক্তির শারীরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। শ্লথন পদ্ধতিতে আপনি কয়েক মিনিট দেহের সমস্ত অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ সমূহ শ্লথন করুন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুন। এরূপ কয়েকবার প্রচেষ্টা গ্রহন পীড়ন হ্রাসে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
(২) অতীত আঘাতমূলক স্মৃতি ভুলে থাকতে কাজের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন : মানসিক আঘাত প্রাপ্তদের-পীড়ন পরবর্তী তাদের নিজের ক্ষমতা ও প্রতিভার  উপর সন্দেহ তৈরি হয় এবং অক্ষমতা বোধে আক্রান্ত হয়। এ প্রকার অক্ষমতাবোধ দূর করার জন্য বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। ঘর গোছনোর কাজে মন দিন, রান্না করুন বা রান্নার কাজে সাহায্য করুন, পছন্দের বই পড়–ন, বাগান করুন, গান শুনুন। এরূপ ব্যবস্থাপনা ব্যক্তির অতীতের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেয়ে স্বাভাবিক জীবন লাভে সহায়ক। 
(৩) বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন : মানসিক আঘাত জনীত কারণে ব্যক্তির মধ্যে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবনতা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের বন্ধুবৎসল হওয়া সময়ের দাবি। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে নিজেকে নিয়োজিত করুন, তাদের হ্যালো করুন, এক সাথে ডিনার করুন, এক সাথে ঘুরতে বের হোন, এক সাথে হাটতে বের হোন, গল্পে এক সাথে মেতে উঠুন। মোট কথা ব্যস্ত জীবনের মূল্যবান সময়কে আনন্দের সাথে অতিবাহিত করুন-তবে দেখবেন পীড়ন কোন প্রকার ঔষধ ব্যতীত এমনিতেই দূর হয়ে গেছে।
(৪) সমর্থন সূচক গোষ্ঠীর সাহায্য গ্রহন করে আত্ম-ধারণাকে উন্নতি সাধনে আত্ম নিয়োগ করুন : মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়নের কারণে ব্যক্তি নিম্ন মাত্রার আত্ম মর্যাদায় ভুগে থাকে। পীড়ন মানুষকে জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। সে জন্য সমর্থন সূচক গোষ্ঠীর সাহায্য গ্রহণ করুন, যারা আপনার ভিতর লুকায়িত বিদ্যমান সম্ভাবনাময় শক্তিকে ফোকাসকরণের মাধ্যমে ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাস তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে।
(৫) রুটিন অনুযায়ী কাজ করতে উৎসাহী হোন : পীড়নের কাল্পনিক চিত্র ব্যক্তিকে বেশি ভাগ সময়ে কষ্ট দেয়। জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতিকে কাজের ব্যস্ততা ভুলিয়ে দিতে সক্ষম। এরুপ পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী ও নিয়মমাফিক রুটিন ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজের অভ্যাস আপনার পীড়ন হ্রাসকরণে অন্যতম সহায়ক হিসেবে বিবেচিত।
(৬) স্বাস্থ্য সম্মত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন : মানসিক আঘাত প্রাপ্তরা রাত্রীকালীন ঘুমের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সমস্যায় ভুগে থাকেন। যদিও অনেক সময় তারা বেশি সময় ব্যাপি ঘুমায় তথাপি তাহা অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ ঘুম  হিসেবে বিবেচিত। নিয়মিত কম পক্ষে সাত থেকে আট ঘন্টা দক্ষ ঘুমের সিডিউল বজায়ে রাখতে প্রাত্যহিক নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন-যা পীড়ন অনেকাংশে দূর করতে সহায়ক।
মানসিক আঘাত পরবর্তী পীড়ন আপনার ভিতরকার সকল সম্ভাবনাকে মুহূর্তে নস্যাত করতে পারে। তাই এরুপ কোন সমস্যা দেখা দিলে এক
জন দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ গ্রহণ করে অথবা উপরের পদক্ষপ সমূহ অনুসরণ পূর্বক সুস্থ ধারার জীবন প্রবাহ লাভ করা সম্ভব। 
লেখক : প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ,খুলনা, ফ্রি পরামর্শ: ০১৭১৪-৬১৬০০১।