খুলনা | রবিবার | ২২ জুন ২০২৫ | ৮ আষাঢ় ১৪৩২

নগরীতে সাড়ে ১২ বছরে তালাক ১৭ হাজার ৩৯৭

বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, এগিয়ে নারীরা

এস এম আমিনুল ইসলাম |
০১:০৪ এ.এম | ১২ অগাস্ট ২০২১

কেউ ভালোবেসে, কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। শুরু হয় একটি সুখের সংসারের পরশ পাথরের গল্প। প্রথম দিকে দাম্পত্য জীবনে বোঝা-পড়াটা হয়ে ওঠে সোনার হাতে সোনার কাকন কে কার অলঙ্কারের মতো ধাধানো। কিন্তু বুকভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা দিচ্ছে না সুখপাখি। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ার সংসারের বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমেই। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ভালো লাগা, ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে। এছাড়া স¤প্রতি প্রভাব ফেলছে করোনা ও লকডাউন। ফলে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সংসার। ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোন কিছুই আটকাতে পারছে না এ বিচ্ছেদ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। তবে এখন বদলে গেছে তালাকের ধরণ। আগে বেশির ভাগ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। কিন্তু এখন বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছে নারীরা। 

কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, ৪৫ দশমিক ৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে খুলনা সিটি কর্পোরেশন গঠিত। গত সাড়ে ১২ বছরে এ কর্পোরেশন এলাকায় অন্তত ১৭ হাজার ৩৯৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ৯৩২টি, ২০১০ সালে ৯৩৩, ২০১১ সালে ১০৭৪, ২০১২ সালে ১১৮১, ২০১৩ সালে ১২৫৪, ২০১৪ সালে ১৪১৯, ২০১৫ সালে ১৪০৪, ২০১৬ সালে ১৪৮৭, ২০১৭ সালে ১৫৯৫, ২০১৮ সালে ১৭১৯, ২০১৯ সালে ১৭০৬, ২০২০ সালে ১৭২৭ এবং চলতি বছরের ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৯৬৬টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তবে কর্পোরেশনে জমা পড়া তালাকের তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তালাক দেয়া পুরুষের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ, আর নারীর সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগ। 

স্বামীকে ডিভোর্স দেয়া এক নারী নাহার বেগম বলেন, কলেজ শিক্ষকের সাথে পরিবারের পছন্দে তার বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামীকে এবং তার আচরণ স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারায় তালাক দেন। এরপর তার জীবন থেকে অন্তত ৭টি বছর চলে গেলেও পরে আর সংসার হয়নি। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করলেও হতাশার মধ্যে জীবন কাটছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা বলেন, স্বামীর সাথে নিজের পছন্দে বিয়ে হয়। কিন্তু সারাক্ষণ স্বামীর সন্দেহ ও পারিবারিক হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি। যার কারণে স্বামীকে তালাক দিয়েছেন। 

মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, সমাজে নারীদের আত্মমর্যাদা, কর্মপরিধি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বেড়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে তারা পেশাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। স্বামীর উপর ভরসা করতে চান না। এ অবস্থায় পরিবারে সমস্যা তৈরি হলে তারা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছেন। উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এ বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। তবে নারীদের কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসলেও নারীরাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের কারনে সমাজে নানা ভাবে হেনস্তা হতে হয়। চরিত্রগত দোষের কথা বলা হয়। আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে গিয়েও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ছে সন্তানের উপর। তারা বেড়ে উঠছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। সমাজ, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে। তাদের মধ্যে জীবন মুখতা তৈরি হয়। পারিবারিক অশান্তি, হতাশা ও অপরাধমূলক কাজের প্রবণতায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়।

খুলনা সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মনস্ত¡াত্বিক বিশ্লেষক প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী বলেন, করোনা ও লকডাউনের প্রভাব, পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, নারী-পুরুষের উভয়ের ভারসাম্যহীন উচ্চভিলাসী মনোভাব, পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ভাবধারার অনুকরণ, সাংসারিক বন্ধনের প্রতি উদাসীনতা, পারিবারিক অভিযোজনের আপোসহীন মনোভাবের উপস্থিতি ইত্যাদি কারনে বিবাহ বিচ্ছেদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এ বিচ্ছেদ প্রতিকারে পারিবার গঠন ও পারিবারিক সম্পর্ক তৈরিতে বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। স্ব-অবস্থান থেকে স্ব-ভূমিকা পালনে বিবেকের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, বাঙালি সংস্কৃতি মননে গভীর চেতনায় লালন, অপসংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহতকরণ, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মর্যাদা প্রদান প্রভৃতি মানসিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হ্রাস করা সম্ভব।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সমাজে তালাক বা ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক বোঝা পড়ার অভাব, পুরুষ-নারীদের মধ্যে নির্ভরশীলতা কমা, নারীদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্বের অভাব, মাদকের নীল ছোবল, পরকীয়া, একাধিক বিয়ের প্রবণতা, অতিমাত্রায় সন্দেহ ও যৌতুক। তাই এটি প্রতিরোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।