খুলনা | শনিবার | ১৯ এপ্রিল ২০২৫ | ৬ বৈশাখ ১৪৩২

আশুরা কেন্দ্রিক কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন আমল

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৪৩ এ.এম | ১৩ অগাস্ট ২০২১

ইতিপূর্বে এই কলামে আমরা আশুরার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জেনেছিলাম। আশুরার দিন বা ১০ই মহররমের রোযা যে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত সেটাও এখানে আলোচনা করা হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইরাক, ইরান ও ভারত উপমহাদেশে; এমনকি আমাদের সমাজেও আশুরাকে কেন্দ্র করে চালু হয়েছে অসংখ্য ভুল ধারণা, কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কর্মকান্ড। এই কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কর্মকান্ডের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। আমরা এখানে শুধুমাত্র অধিক প্রচলিত কয়েকটি কুসংস্কার ও ভুল ধারণা সম্পর্কে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
আশুরার আমল ইমাম হুসাইনের কারণে : আমাদের দেশে এই ধারণার প্রচলন আছে যে, কারবালার প্রান্তে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের কারণে আশুরার আমল ও রোযা রাখা হয়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ হলো, রোযার প্রচলন করেছেন মহানবী সল­াল­াহু আলাইহিস সালাম যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। আর ইমাম হুসাইন রাযিয়াল­াহু আনহু শহিদ হয়েছেন আল­াহর রসুলের ওফাতের অনেক পরে। আল­াহর রসুলের ইন্তেকালের পরে নতুন কোন শরিয়তের আহকাম চালু হতে পারে না।
মহররম মাস অশুভ : অনেকে মহররম মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করেন। কেউ কেউ আবার কুফু শব্দটি ব্যবহার করেন। এমনকি অনেকে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ মাসে করতে চান না। যেমন অনেক মুসলমান এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকেন। এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কোন মাস বা দিন অশুভ নয়।
শোকমাতম ও বুকে আঘাত করা : আল­াহর রসুল সল­াল­াহু আলাইহিস সালাম হাদিসে শোকমাতম করতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে। কিন্তু আমাদের দেশে এক শ্রেণির বিভ্রান্ত মানুষের মাঝে ইমাম হুসাইন রাযিয়াল­াহু আনহুর শাহাদাৎকে কেন্দ্র করে শোক পালন, শোক মাতম, শোকগাঁথা পাঠ, শোক মিছিল ও জমকালো র‌্যালী, তাজিয়া, শোকে জামা-কাপড় ছিড়া, বুক চাপড়ানো, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি কর্মকান্ড করে থাকে। এগুলো সবই কু-প্রথা। আমরা সকলেই জানি, ইসলামের বিশিষ্ট খলিফা হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত উসমান (রা.) সকলেই শহিদ হন। এমনকি ইসলামে সকল শহিদদের নেতা হলেন নবী সল­াল­াহু আলাইহিস সালামের আপন চাচা হামজা রাযিয়াল­াহু আনহু। তাদের শাহাদাৎকে কেন্দ্র করেই যখন কোন শোকপালন করা হয় না, সেখানে ইমাম হুসাইন রাযিয়াল­াহু আনহুর শাহাদাৎকে কেন্দ্র করে শোক পালনের কোন ভিত্তি থাকতে পারে কি?
আশুরা বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা : উড়িয়া যায়রে জোড়া কবুতর, ফাতেমা কেন্দে কয়, আজ বুঝি কারবালার আগুন লেগেছে মোর কলিজায়। মা ফাতেমার কান্দন শুনে আরশ থেকে আল­াহ কয়, যাওগো জিব্রিল বাতাস কর মা ফাতেমার কলিজায়, পুত্র শোকে কলিজা জ্বলে বাতাসে কি ঠান্ডা হয়। এই সমস্ত মিথ্যা কথা ও কেচ্ছা কবিতা ও গানের আকারে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। এ গুলো যে মিথ্যা তার প্রমাণ হলো, মা ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন ১১ হিজরিতে আর হুসাইন (রাঃ) শহিদ ৬১ হিজরিতে। দুই জনের মাঝে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধান। এই ধরনের অসংখ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে আশুরা ও মহররমকে কেন্দ্র করে। এছাড়া আরও আছে : আশুরার দিনে আল­াহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি লাওহে মাহফ‚য সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদ-নদী.... সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন। এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আ.) সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি আদমকে (আ.) সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তিনি আদমকে (আ.) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আ.) আসমানে উঠিয়ে নেন। এ দিনে তিনি নূহ (আ.)- কে নৌকা থেকে বের করেন। এ দিনে তিনি দাউদ (আ.) -এর তওবা কবুল করেছেন। এ দিনে তিনি সুলাইমান (আ.)- কে রাজত্ব প্রদান করেছেন। এ দিনে তিনি আইঊব (আ.)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন। এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন। এ দিনে ইবরাহীম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন। এ দিনে ইবরাহীম (আ.) নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান। এ দিনে ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানী করা হয়েছিল। এ দিনে ইউনূস (আ.) মাছের পেট থেকে বাহির হন। এ দিনে আল­াহ ইউসূফ (আ.) কে জেলখানা থেকে বের করেন। এ দিনে ইয়াকুব (আ.) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান। এ দিনে ইয়াক‚ব (আ.) ইউসূফের (আ) সাথে সম্মিলিত হন। এ দিনে মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন। এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....। অনেকে আবার বলেন, মহররমের ২ তারিখে নূহ (আ.) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদ্রীসকে (আ.) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আ.) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরূপ অগণিত ঘটনা মহররম মাসে বা আশুরার দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উলে­খ করা হয়েছে। এ সমস্ত বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র মহান আল­াহ তায়ালার কাছেই আছে। নির্ভরযোগ্য হাদিস বিশারদদের কাছ থেকে জানা যায়, আশুরার দিনে মূসা (আ.) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আশুরার ভিত্তিহীন আমল ও রোযা : সহীহ হাদিস দ্বারা এটা প্রমানিত যে আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহের কাফ্ফারা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমাদের দেশে আশুরা ও মহররম মাসকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ভিত্তিহীন আমলের কথা অনেকে বলে থাকেন। 

যেমন : যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল­াহ তায়ালা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। অথবা, যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহিদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। কিংবা, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। এছাড়াও রয়েছে, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোযা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোযা রাখিল এবং রাত্রি বেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। ... মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ধরনের অসংখ্য আমলের কথা বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য লেখনি, বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। এগুলোর বেশিরভাগই শিয়া মতবাদের লেখককের লেখা। এ কথা জানা জরুরি যে, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। কিন্তু এ প্রসঙ্গে অনেক পুস্তকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ... অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে ... সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য বিভ্রান্ত এক শ্রেণির লেখক এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। সহিহ হাদিস থেকে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আশুরার রোযা রাখা সুন্নত এবং সাহাবায়ে কেরাম এই রোযার এহতেমাম করতেন। তাই আসুন, আমরা সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে সুন্নত-মোতাবেক আমল করি। 
লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।